Advertisement
২১ মে ২০২৪

‘চাঁদের আবছা আলোয় চোখ জ্বলে ওঠে’ উত্তরের প্রান্তিক নারীসমাজের

বহুমুখী শোষণের যূপকাষ্ঠে বদ্ধ এক দল অনামী মেয়ে নেমে এসেছিলেন পথে, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কৃষক আন্দোলনের। লিখছেন সুতপা সাহাচম্পা ওরাওঁ, কৃষ্ণা ওরাওঁ, করমি উরাওনি, বধুনি উরানি, স্বর্ণময়ী উরাওনিদের নাম।  কারা এঁরা? কেনই-বা এঁরা শহিদ হলেন? 

তেভাগা: আন্দোলনে উত্তরের জনজাতি। —ফাইল ছবি।

তেভাগা: আন্দোলনে উত্তরের জনজাতি। —ফাইল ছবি।

শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৯ ০৫:৩৪
Share: Save:

জলপাইগুড়ি জেলার চালসা মোড়ে শহিদ বেদির স্মৃতিস্মারকে বহু শহিদের নামের মধ্যে রয়েছে এই নামগুলোও— চম্পা ওরাওঁ, কৃষ্ণা ওরাওঁ, করমি উরাওনি, বধুনি উরানি, স্বর্ণময়ী উরাওনিদের নাম। কারা এঁরা? কেনই-বা এঁরা শহিদ হলেন?

‘হারাণের নাতজামাই’ গল্পের প্রথম অংশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন— ‘শীতের তে-ভাগা চাঁদের আবছা আলোয় চোখ জ্বলে ওঠে চাষীদের।’ সচেতন পাঠক লাইনটি পড়েই বুঝতে পারবেন, লেখক কোন প্রতিবাদী সময়ের কথা বলছেন। সেই সময় কৃষক নিপীড়নের পাশাপাশি নারীর উপর শোষণ ও অত্যাচারও ছিল সামন্তপ্রভুদের স্বেচ্ছাচারিতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মেয়েরা এক দিকে যেমন ছিলেন স্বামীর কাছে পণ্যস্বরূপ, অন্যদিকে ছিলেন জোতদারেরও সম্পত্তি। চরম অভাব ও দারিদ্র্যে কৃষিঋণ শোধ করতে না পেরে মহাজনের হাতে ঘরের মেয়ে-বউদের তুলে দেওয়া বা বিক্রি করে দেওয়া কোনও নতুন ঘটনা ছিল না সেই সময়। সেই পঙ্গু কৃষকসমাজে মেয়েরা যে আরও কত পশ্চাৎপদ ছিলেন, তা সহজে অনুমেয়। ফলে, তার পরবর্তী সময়ে, কৃষক আন্দোলনের সময়, ক্রমাগত অত্যাচারিত এই মেয়েদের সংগঠনে কিংবা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতিতে যোগদান বা প্রতিরোধ-প্রতিবাদ ছিল অনেকটাই স্বতস্ফূর্ত। পুঁথিপত্রে এই মহিলাদের হদিস হয়তো সে ভাবে পাওয়া যাবে না। যেমন, বুড়িমা পুণ্যেশ্বরী বর্মণের কথা। বুড়িমার শিক্ষায় গ্রামের মেয়েরা হয়ে উঠেছিলেন দক্ষ খবর-হরকরা। তাঁর নেতৃত্বে মাকড়ি, উজানি, বিদ্যারা যেমন ধান ভাগ করা থেকে গোলায় ধান তোলার কাজ করেছেন, তেমনই পুলিশের মোকাবিলাও করেছেন। কর্মীদের রেঁধে খাওয়ানো, তাঁদের লুকিয়ে রাখা, পালাতে সাহায্য করা— সব কাজ তাঁরা করতেন।

তখন ডুয়ার্সে ইঞ্জিনের সামনে লালঝান্ডা লাগিয়ে দোমহনি থেকে ট্রেন চলছে— এই দৃশ্য হামেশাই চোখে পড়ত। আন্দোলন প্রথমে শুরু হয়েছিল ওদলাবাড়ি , ক্রান্তি, ডামডিম প্রভৃতি জায়গা থেকে। মহিলাদের সামনের সারিতে থাকতেন যমুনা ওরাওঁ (রেডব্যাঙ্ক চা-বাগানের কর্মী), নৈহারি ওরাওঁনি, এতোয়ারি ওরাওঁনি, পোকো ওরাওঁনি, মহারানি ওরাওঁনি প্রমুখ। পুলিশের গুলিচালনা ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল চালসার মঙ্গলবাড়িতে গয়ানাথের খোলায়। মারা গিয়েছিলেন একজন মহিলা এবং তেরো বছরের এক ছেলে। নেওড়া মাঝিয়ালির পোকো উরাইন, চুন্দিয়া উরাইনদের বয়স তখন ছিল বারো থেকে পঁচিশের মধ্যে। একবার প্রায় দু’শো জন মেয়ে নিয়ে মিছিল করে ফেরার পথে এক বিপ্লবীর খোঁজে পুলিশ ওঁদের বাড়িতে হাজির। মেয়েরা সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাইরের গোয়ালঘরে আগুন লাগিয়ে শোরগোল তুলে দেন। আশপাশের অগুনতি লোক জড়ো হয়ে যান। পুলিশ শেষ পর্যন্ত পিছু হটে। সেই বিপ্লবীও নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিস্তাপাড়ের এ পারের এই রেল চা-বাগান সংলগ্ন কৃষক এলাকায় তখন কোমর বেঁধেছিলেন বহু মেয়ে। বানারহাট বিন্নাগুড়ি অঞ্চলে চা-বাগান ঘেঁষা গ্রামগুলোয় মেয়েরাই পুলিশের দলকে পাথর ছুড়ে তাড়া করে পিছু হটিয়ে দিতেন। অত্যাচারী জোতদারকে গাছের সঙ্গে বেধেঁ শাস্তি দিতেন মেয়েরাই, নেওড়া মাঝিয়ালির পোকো ওরাওঁ আর তাঁর বোনেরা।

একটি মাত্র ময়লা কাপড়, এক বেলা খাওয়া, নিরাভরণ বাঁশের ঘর, নিষ্প্রদীপ রাত্রি, পাঠশালা-হীন ডাক্তার-হীন জীবন। অথচ, অসম্ভব আত্মত্যাগ, সাহস আর দরদি মন নিয়ে এই মেয়েরা সংগঠনের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ মনে হলেও এই মেয়েদের পক্ষে সে যুগে, সেই পরিবেশে কাজটা সহজ ছিল না মোটেই। এঁদের না ছিল তেমন প্রশিক্ষণ, না ছিল তেমন হাতিয়ার, না ছিল সামাজিক সচেতনতার পাঠ, না ছিল নারীর সমমর্যাদা নিয়ে কোনও পুঁথিগত বিদ্যার অহঙ্কার।

মেয়েদের ভূমিকা বিষয়ে এক বিশ্লেষণে লেনিন বলেছিলেন— ‘প্যারি কমিউনের মতোই বুর্জোয়া শক্তিকে উৎখাত করবার জন্য প্রলেতারিয়েত মহিলারা এগিয়ে আসবেনই, অংশগ্রহণ করবেন বিপ্লবী প্রলেতারিয়েত হিসেবে।’ লেনিনের বক্তব্য কী আশ্চর্য ভাবে রূপ নিয়েছিল বাংলার প্রান্তসীমানাতেও। গ্রামীণ নারী-জাগরণের এই মহান ইতিহাস নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসের সাফল্যকেই মহিমান্বিত করে।

এ বছর নারীদিবসের বিশ্বব্যাপী যে ক্যাচলািন, তা হল— ভালর জন্য ভারসাম্য (ব্যালেন্স ফর বেটার)। ভারসাম্য রক্ষার এই প্রকৃষ্ট উদাহরণ আবারও আমাদের বাধ্য ক‍রবে ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে।

(লেখক শিলিগুড়ি সূর্য সেন কলেজের ইংরেজির শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত। উদ্ধৃতির বানান অপরিবর্তিত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Class Struggle North Bengal Women Power
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE