নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
সনিয়া গাঁধীও সম্ভবত জানেন, জরুরি অবস্থার ভুল স্বীকার করিবার জন্য এত উপযুক্ত সময় গত চার দশকে আর আসে নাই। গত চল্লিশ বৎসরের কোনও একটি মুহূর্ত এমন ভয়াবহ হইয়া উঠে নাই, যাহার তুলনায় জরুরি অবস্থার অন্ধকার দিনগুলিকেও এতখানি নিরীহ বোধ হইবে। নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালের তিনটি বৎসর ভারতীয় গণতন্ত্রকে সেই মুহূর্ত উপহার দিয়াছে। কিন্তু বিজেপিকে কখনও এই অবস্থার জন্য ভুলস্বীকার করিতে হইবে না, ক্ষমাপ্রার্থনা করিতে হইবে না। কারণ, ইহা ‘জরুরি অবস্থা’ নহে, ইহা ‘স্বাভাবিক অবস্থা’। সর্বগ্রাসী অন্ধকার এতটাই গাঢ় ও নিশ্ছিদ্র যে, তাহার ভয়ংকর অস্বাভাবিকতাও আর দৃষ্টিগোচর হইতেছে না। গোমাংস ভক্ষণের অভিযোগে বাড়িতে চড়াও হইয়া প্রৌঢ়কে খুন করা হইতে ট্রেনের কামরায় কিশোরহত্যা, সামরিক জিপের সম্মুখে এক নাগরিককে বাঁধিয়া ঘুরাইবার ইনাম হিসাবে রাষ্ট্রীয় সম্মানপ্রদান, রাষ্ট্রদ্রোহিতার ওজরে বিরুদ্ধমতকে পদপিষ্ট করা— এই ভারতে সকলই স্বাভাবিক। দাঙ্গার ‘প্রমাণ’ হিসাবে ভুয়া ভিডিয়ো রেকর্ডিং প্রচার করা স্বাভাবিক, মুসলমানদের পাকিস্তানে চলিয়া যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া স্বাভাবিক, প্রকাশ্য জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শ্মশান ও করবস্থানের সংখ্যার তুলনা করিলে তাহাও স্বাভাবিক। কারণ, ‘এমনটাই হইয়া থাকে।’ এই চরম অস্বাভাবিকতাকেও যে স্বাভাবিক, ও ক্রমে বৈধ, হিসাবে মান্য করিয়া তোলা সম্ভব, তাহা প্রমাণ করাই বর্তমান জমানার বৃহত্তম কৃতিত্ব। নরেন্দ্র মোদীর নিকট ইন্দিরা গাঁধী দশ গোল খাইয়াছেন। মনে হয়, আরও অনেক গোল খাইবেন।
ইন্দিরা জমানা যাহা পারে নাই, মোদী যুগ তাহা পারিয়াছে— গণতন্ত্রের বিচ্যুতিকে ‘বৈধতা’র স্বীকৃতি আনিয়া দেওয়া। জরুরি অবস্থা চলাকালীন বিস্তর দমনপীড়ন হইয়াছিল, তাহার প্রতিবাদও হইয়াছিল। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের প্রতিবাদে সংবাদপত্র সাদা পাতা ছাপিয়াছিল। নাগরিক সমাজের কার্যত প্রতিটি পরিসর হইতে ধ্বনিত হইয়াছিল প্রতিস্পর্ধার কণ্ঠস্বর। নরেন্দ্র মোদীর আমলে সেই প্রতিবাদ ক্ষীণস্বর। লেখকরা সাহিত্য আকাডেমি খেতাব ফিরাইয়া দিয়াছেন; বিজ্ঞানী হইতে চলচ্চিত্র অভিনেতা, সব পেশা হইতেই প্রতিবাদ শোনা গিয়াছে। কিন্তু তাহার তেজ ক্রমে প্রশমিত হইয়াছে। এবং, সেই প্রতিবাদ মূলত ব্যক্তিগত। প্রতিষ্ঠান প্রতিবাদ করে নাই। মিডিয়ার বৃহত্তর অংশটি চুপ, অথবা মোদী-ভজনায় মগ্ন। অনুমান করা চলে, এই নীরবতার একটি কারণ ভয়। ক্ষমতাকে চটাইলে কী হইতে পারে, তাহার ভয়। কিন্তু, পাশাপাশি একটি অন্য আশঙ্কাও সম্ভবত রহিয়াছে— এই অস্বাভাবিকতাগুলিকে প্রশ্ন করিলে সেই প্রশ্নটিই ‘অবৈধ’ হইয়া যাইবে না তো? কানহাইয়া কুমারদের অত্যন্ত সঙ্গত এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের যে পরিণতি হইয়াছে?
ইহাই নরেন্দ্র মোদীদের জয়। তাঁহারা যাহা ভাবেন, বলেন, বিশ্বাস করেন, এবং রাষ্ট্রকে দিয়া বলাইয়া লন, শুধু সেই কথাগুলিই বৈধ, বাকি সব অ-বৈধ— এই বিশ্বাসটি জনমানসে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। কাশ্মীরের মানুষের ন্যায্য ক্ষোভও যে দেশদ্রোহিতা, দেশ দেশ জুড়িয়া এমন একটি বিশ্বাস নির্মাণ করিতে পারা কম কথা নহে। সঙ্ঘ পরিবার নির্মিত সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা, উগ্র হিন্দুত্বকেই জাতীয়তাবাদ বানাইয়া দেওয়া— অস্বাভাবিকতা এই ভাবেই বৈধতা অর্জন করিয়াছে। মাধব সদাশিব গোলওয়ালকরের যে কথাগুলি বহু দশক উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড-এর দুই মলাটে বন্দি ছিল, তাহাই এখন ভারতীয় রাষ্ট্রের পথপ্রদর্শক হইয়াছে। এমন অন্ধকার ভারতীয় গণতন্ত্র দেখে নাই। কিন্তু, নরেন্দ্র মোদীর উত্তরাধিকারীরা তাঁহার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকিবেন। এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিবার দায় তাঁহাদের থাকিবে না। স্বাভাবিকতার প্রায়শ্চিত্ত হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy