Advertisement
২৮ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

অব গোলি খা!

প্যানপেনে বার্তা খুব শুনছি, বাঙালি হয়ে এমন করল! কেন, বাঙালি কি এমনই নীরক্ত অল্পতেজা, যে তার রুদ্রমূর্তি কল্পনা করতেও হেঁচকি ওঠে?সা রা ক্ষণ রাগ গিলতে গিলতে পেট জয়ঢাক হয়ে যাচ্ছে, এর ঝাল ওর ওপর ঝেড়ে হাল্লাক হয়ে যাচ্ছে লোক, রাগের চোটে ঘুমোতে পারছে না, বারান্দায় দাঁড়িয়ে শয়ে শয়ে সিগারেট পোড়াচ্ছে আর তার টুকরোগুলোকে পায়ে নিষ্ঠুর কচলাচ্ছে, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মুঠো পাকিয়ে বিড়বিড় করছে আর মন-সিনারিতে মুখতোড় জবাব দিচ্ছে পাঁচ বছর সাত বছর উনিশ বছর পরে ট্যাক্সিওলাকে ঘুগনিওলাকে বউকে হেডমাস্টারকে, আবার সবাই কিনা আমায় যা-তা বলছে— রাগের টার্গেটটাকে নিকেশ করেছি বলে!

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

সা রা ক্ষণ রাগ গিলতে গিলতে পেট জয়ঢাক হয়ে যাচ্ছে, এর ঝাল ওর ওপর ঝেড়ে হাল্লাক হয়ে যাচ্ছে লোক, রাগের চোটে ঘুমোতে পারছে না, বারান্দায় দাঁড়িয়ে শয়ে শয়ে সিগারেট পোড়াচ্ছে আর তার টুকরোগুলোকে পায়ে নিষ্ঠুর কচলাচ্ছে, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মুঠো পাকিয়ে বিড়বিড় করছে আর মন-সিনারিতে মুখতোড় জবাব দিচ্ছে পাঁচ বছর সাত বছর উনিশ বছর পরে ট্যাক্সিওলাকে ঘুগনিওলাকে বউকে হেডমাস্টারকে, আবার সবাই কিনা আমায় যা-তা বলছে— রাগের টার্গেটটাকে নিকেশ করেছি বলে! গোটা বাংলাটাকে, বাংলা কেন, পৃথিবীটাকেই, একটা রাগের দপদপে তপ্ত লাল লাইন দিয়ে জুড়তে শুরু করলে ক’মুহূর্ত পরেই পাওয়া যাবে একটা ঘিজিবিজি টকটকে ম্যাপ, যার প্রায় একটা বিন্দুও আর অ-রক্ত নেই। তা হলে আমি যা করেছি, সেটাই তো সহজ যৌক্তিক, সেটাই তো গণিতের মতো স্বাভাবিক। আমার লোকটার ওপর ক্রোধ জন্মেছে, আমি তাকে গুলি করে দিয়েছি। ছোট ছেলেরা অবধি রেগে গেলে ঠাম্মাকে বলে, তুমি মরে যাও। বসের অপমান খেয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে আমরা বিড়বিড়োই, শালা পৃথিবী থেকে মুছে যাক! আমরা কি যুধিষ্ঠিরের চেয়ে ভীমকে বেশি ভালবাসি না? দুঃশাসনের বুক চিরে রক্ত খাওয়াকে জম্পেশ জাস্টিস মনে করি না? কৃষ্ণ সবার সামনে শিশুপালকে চক্র দিয়ে ঘ্যাচাং করলেন, আমরা আন্তরিক ক্ল্যাপ মারিনি? সিনেমার পর সিনেমায় লাস্ট সিনে হিরো ভিলেনকে মেরে পাট করছে দেখে আমাদের হৃদয় থেকে ফোয়ারা চড়াং উঠে সিলিং টাচ করে আসেনি? এক গালে থাবড়া খেলে দু’গালে মেরে তার শোধ দাও, এটাই আসলে পৃথিবীর শিক্ষা।

ক্ষমা-টমা কয়েকটা লব্‌জ আওড়াতে হয় বটে, কিন্তু সে হল ন্যাকা ন্যাকা বাক্য বাগিয়ে নোবেল পিস পাওয়ার ধান্দা। বা, পাড়ার সভা আলো করে বসে থাকার বুকনি। টাক থেকে এট্টু আলো, হাসি থেকে ডিটারজেন্ট। এ আঁতলামোর সঙ্গে বাস্তবের যোগ কোথায়? যারা এই ক্ষমাবাজদের বক্তিমে শুনে ফেঁপে উঠে তাদের পায়ে পেন ঠেকায়, তারাই মোবাইল-চোরকে ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে বেধড়ক্কা পেটায়। পেটাবে না-ই বা কেন? টেক্সবইয়ের চ্যাপটার গিলে তো আর জীবন বাঁচা যায় না। আর স্বয়ং ট্রমাবিরোধী ক্ষমাসুন্দর ঠান্ডাপার্টি? তারাও নিজের মেয়েকে টোন কাটলে লোফারের দিকে আধলা ছোড়ে, ছেলেকে ইট মেরে মাথা ফাটিয়েছে যে খেলুড়ে বন্ধু, তার বাপ-মা’র সঙ্গে ইতর কাঁউকাঁউ ঝগড়া করে আসে। কারণ, টিভিতে বা কাগজে যখন গর্জেছিল— খ্যাতির মোহ, আর থিয়োরি কুলকুচোর তৃপ্তিতে ডগমগিয়েছিল। প্র্যাকটিকাল পৃথিবী ঘাড়ে টোকাটি মারতেই, রিভেঞ্জিব রিভেঞ্জিব বলে আসিতেছে চলে। বাপু, আদিম যুগ থেকে আজ অবধি, অহিংসা-আইকনদের স্ট্যাচুটুক নির্মাণ হয়, তার বেশি সেমিনারচব্ব ধরিত্রীতে ফলে না। যে হাতি খেতের ফসল তছনছ করেছে, গ্রামের লোক তাকে বিষ দেবেই। নোট চুরি যাওয়ার ক্ষোভে আমি প্রফেসরকে গুলি করবই। এই তেড়িয়া শোধাশোধিই পৃথিবীকে স্পিন খাওয়াচ্ছে। এতে যদি আঁক করে বসে পড়ো, তোমার টিআরপি বাড়বে, কিন্তু সত্যের খাতায় নীতিভেড়ার নামে ঢ্যাঁড়া!

রাগ হার্টবিটের মতো। নাগাড়, নাছোড়। হবে না কেন, প্রায় সব্বারই তো বঞ্চনা অপমানের বালিতে মুখটা ঘষটে ছড়ে যাচ্ছে। টাকা নেই। ইএমআই আছে। ছেলে বড় স্কুলে চান্স পাচ্ছে না। মেয়ে সারা দিন ফোনে গুজুরগুজুর করছে। মুদি ঠকাচ্ছে, অটোওলা খারাপ ব্যবহার করছে, কলিগ ঠেস দিয়ে কথা বলছে, বন্ধু চেহারা নিয়ে খোঁটা দিচ্ছে, রাস্তায় পাগলের মতো হর্ন বাজছে, ফিল্মমেকার হওয়ার সাধ ছিল কেরানি হয়ে আয়না-ঘেন্না করতে হচ্ছে। পুলিশ হ্যারাস করছে, নেতা মার খাওয়াচ্ছে। লোকটা গাঁ-গাঁ আর্তনাদ করে উঠবে, সে জায়গাটুকু নেই। বাথরুম ছোট্ট, টিকটিকিওলা। তবু সে লোহার রড দিয়ে সেই ডাক্তারটার মাথা ফাটাচ্ছে না কেন যে বুড়ো বাবার গল ব্লাডার অপারেশন করতে গিয়ে কী একটা কেটে ফেলল আর তারা ধনেপ্রাণে সর্বস্বান্ত হয়ে গেল? সেই উকিলটাকে অ্যাসিড দিয়ে পোড়াচ্ছে না কেন যে বলেছিল কোনও ব্যাপারই না মিষ্টি খাওয়ান তার পর মামলার দিন কোর্টেই এল না কী একটা অজুহাতে এবং কেস হেরে গয়না বেচে সর্বস্ব দিতে হল শয়তান বাড়িওলাকে? কারণ এই নয় যে বিরাটহৃদয় পাবলিক ক্ষমা শিখে গেল। এই নয় যে ব্যাংকের কাছ থেকে পালাতে পালাতে টিটকিরির কাছ থেকে পালাতে পালাতে টিভিতে সেঁধিয়ে মদের বোতলে চুবে সে সহসা বুঝতে পারল, মারলেও কলসির কানা হওয়া উচিত প্রেমদিওয়ানা। কারণ সিম্পলি এই, রড মারা বা অ্যাসিড ছোড়ার ধক এদের গজাল না। আমি কেন উঁচুয়া? কারণ আমি যে প্রফেসরকে ঘেন্না করেছি, তাকে হত্যা করার সাহস ও মুরোদ আমার আছে। তার পর, এই পৃথিবী যাতে তার গাঁটওঠা গামবাট গোবদা আঙুল দিয়ে আমায় সাঁড়াশি-পাকড়াতে না পারে, তাই নিজেকেও শেষ করে দেওয়ার খ্যামতা আছে। তাই আমি নিজেকে সামলাতে না পারার জন্য ওঁচা নই, ফ্যান্টাসিকে সত্যি করতে পারার জন্যে হিরো।

একটা প্যানপেনে বার্তা খুব শুনছি, বাঙালি হয়ে এমন করল! কেন, বাঙালি কি স্পেশাল মহৎ কোনও জাত, যে কোঁৎ করে ক্রোধ গিলে তক্ষুনি ভুবনজয়ী বোধকাব্যি উগরে দেয়? না কি সে এমনই নীরক্ত অল্পতেজা, যে তার রুদ্রমূর্তি কল্পনা করতেও হেঁচকি ওঠে? আরে সেই মর্মে যদি কথা রটে থাকে বিশ্বময়, তা হলে তা দাবড়ে শোধরাবার দিন এসেছে! শোধরাব আমি, শোধরাবে লন্ডনের সিদ্ধার্থ ধর, যে আইএস-এর একখান চনমনে চাঁই। নয়া অনুশীলন সমিতি গড়ার, ঘোড়ার পিঠে চেপে শাঁইশাঁই তরোয়াল ঘুরিয়ে এন্ট্রি নেওয়ার সিন এসেছে। বোম মার, উড়িয়ে দে, কাটা মুন্ডু নিয়ে গেন্ডুয়া খেল! দুনিয়ার লোক, অ্যাদ্দিন মিনমিনে বাঙালির খরগোশ-হৃদয় নিয়ে অট্টহেসে বিষম খেয়েছিস, অব গোলি খা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE