Advertisement
০৭ মে ২০২৪

আদালত কিন্তু রাষ্ট্রের যুক্তি চাপিয়ে দিতে বারণ করছে

কোর্টের রায়ের এই পাঠ বিজেপি-র হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের জন্য জরুরি। কারণ, যে রাজনীতিকে তারা ‘মুসলমান তোষণ’ বলে চিহ্নিত করেছে, এখন তাকে ‘আধুনিক’ রাষ্ট্রের বিরোধী অবস্থান হিসেবেও দেগে দেওয়া যাবে।

অভিবাদন: তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধ করার লড়াইয়ে মুসলিম মেয়েদের অগ্রণী ভূমিকা আশা জাগায়। দিল্লি, ২২ অগস্ট। ছবি: পিটিআই

অভিবাদন: তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধ করার লড়াইয়ে মুসলিম মেয়েদের অগ্রণী ভূমিকা আশা জাগায়। দিল্লি, ২২ অগস্ট। ছবি: পিটিআই

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৭ ০৬:০০
Share: Save:

একটা বর্বর প্রথা বন্ধ হলে সভ্য সমাজ উচ্ছ্বসিত হবে, স্বাভাবিক। দীর্ঘ অপমানের পর মুসলমান মেয়েরা স্বাভাবিক সম্মানের অন্তত কিয়দংশ পাবেন, সেই প্রত্যাশায় উল্লাস থাকতেই পারে। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরাও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। তালাক-ই-বিদ্দত বা তাৎক্ষণিক তিন তালাককে বে-আইনি ঘোষণা করার নির্দেশটিকে তাঁরা ‘ঐতিহাসিক’ বলেছেন। জানিয়েছেন, ভারতে মুসলমান মেয়েদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে সূচনা হল এক নতুন যুগের। মুসলমান নন, তিন তালাকে বিচ্ছিন্ন হননি, কিন্তু স্বামী-পরিত্যক্তা, এমন এক এবং অনেক মহিলার ন্যায়বিচারের কী হবে, নরেন্দ্র মোদী সে প্রশ্নের উত্তর দেননি। প্রশ্নটি আপাতত স্থগিতই থাক। কারণ, অনুমান করা চলে, (মুসলমান) মহিলাদের ন্যায়বিচার নিয়ে মোদী-শাহদের যত মাথাব্যথা, তার চেয়ে ঢের বেশি চিন্তা একটি বার্তা নিয়ে— মুসলমান সমাজ এমনই পশ্চাৎপদ যে তিন তালাক প্রথা বন্ধ করার মতো একটা জরুরি সংস্কারও সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্ভব হয় না। অথবা, আরও একটু এগিয়ে গিয়ে বললে, ‘আধুনিক’ রাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে মুসলমান সমাজ অক্ষম, অতএব সেই সমাজের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্যদের— অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের, হিন্দুদের— হস্তক্ষেপ করা ভিন্ন উপায় নেই। শীর্ষ আদালতের যে রায়কে তাঁরা এ ভাবে পড়ছেন, তাকে ‘ঐতিহাসিক’ ছাড়া আর কী বা বলা যায়?

কোর্টের রায়ের এই পাঠ বিজেপি-র হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের জন্য জরুরি। কারণ, যে রাজনীতিকে তারা ‘মুসলমান তোষণ’ বলে চিহ্নিত করেছে, এখন তাকে ‘আধুনিক’ রাষ্ট্রের বিরোধী অবস্থান হিসেবেও দেগে দেওয়া যাবে। বলে দেওয়া যাবে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত যে সমাজের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও আলোচনার প্রক্রিয়ার ওপর ভরসা রাখতে পারে না, এই রাজনীতি শুধু ভোটের স্বার্থে জিইয়ে রাখতে চায় তাকে। বলা যাবে, ন্যায়বিচারসংগত রাষ্ট্রের পথে হাঁটার একমাত্র রাস্তা হল অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। বলা যাবে, নেহরু যে সংস্কারের সাহস দেখাননি, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাজনীতি যে সংস্কারকে ঠেকিয়ে রেখেছে, ভারত এখন সে পথে কুচকাওয়াজ করবে।

এবং, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের এই ব্যাখ্যাটি সম্পূর্ণ ভুল— বস্তুত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ভুল— হবে। মুসলিম পার্সোনাল ল’ মুসলমানদের মানবাধিকারের পক্ষে কতখানি মন্দ, সেটা বড়, এবং আলাদা প্রশ্ন। আদালত সেই প্রশ্নে ঢোকেনি। কেন, প্রধান বিচারপতি তা ব্যাখ্যা করেছেন। জানিয়েছেন, ভারতের সংবিধান অনুসারে মুসলিম পার্সোনাল ল’কে সাংবিধান প্রশ্নের মুখে ফেলা যায় না। অর্থাৎ, মোদীদের কাছে যে কারণে রায়টি ‘ঐতিহাসিক’, সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান তার বিপ্রতীপ।

পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ তিন তালাক বিষয়ে সহমত হয়নি। যে তিন জন বিচারপতি তিন তালাক প্রথা বিলোপের পক্ষে রায় দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও যুক্তির ভেদ আছে। বিচারপতি কুরিয়ন জোসেফ বিচারপতি রোহিনটন নরিমান ও উদয় ইউ ললিতের সঙ্গে একমত যে এই প্রথাটি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কেন? বিচারপতি কুরিয়ন লিখেছেন, তিন তালাক প্রথাটি ইসলামসম্মত নয় বলেই। ‘পবিত্র কোরানে যে প্রথাটি মন্দ বলে চিহ্নিত, শরিয়তি আইনে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’ অর্থাৎ, তিন তালাকের প্রশ্নটিকে তিনি ‘বাইরে থেকে সংস্কার’-এর চশমায় দেখেননি, দেখেছেন ইসলামের অভ্যন্তরীণ যুক্তিতে।

অন্য দিকে, যে দুই বিচারপতি তিন তালাককে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে রায় দিয়েছেন— প্রধান বিচারপতি জে এস খেহর এবং বিচারপতি আবদুল নজির— তাঁরা উল্লেখ করেছেন মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের জারি করা একটি নির্দেশিকার কথা। এই মামলা চলাকালীন ল’ বোর্ড সেই নির্দেশিকায় জানায়, বিয়ে করার সময় যে নিকাহ্‌নামা তৈরি হয়, সেখানেই দম্পতিদের জানিয়ে দেওয়া উচিত যে ‘তালাক-ই-বিদ্দত’এর পথে এই বিয়ে ভাঙা হবে না। বিচারপতি খেহর লিখেছেন, তিন তালাকের প্রশ্নে পার্সোনাল ল’ বোর্ডও যে ঠিক তরফেই আছে, সে কথা বললে ভুল হবে না। বিচারপতি খেহরের মন্তব্যের অতিসরলীকরণ প্রয়োজন নেই। পার্সোনাল ল’ বোর্ডকেও বেকসুর খালাস করতে হবে না। কিন্তু, তিন তালাকের মতো একটি বর্বর প্রথার— আরও অনেক ‘ব্যক্তি অধিকার-বিরোধী’ প্রথার— অবসান মুসলমান সমাজের ভিতর থেকেই হতে পারে, আদালতের এমন একটি আশাবাদ এই মন্তব্য থেকে পড়ে নেওয়া যেতেই পারে। ইঙ্গিত আরও রয়েছে। বিচারপতি খেহর তাঁর রায়ে লিখেছেন, বিশ্বের বহু দেশে, এমনকী মুসলমান রাষ্ট্রেও, শরিয়তি আইন কী ভাবে সংস্কার করা হয়েছে, তা থেকেও শেখার আছে। অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদীরা যে ভাবেই রায়টিকে পড়ুন না কেন, সর্বোচ্চ আদালত কিন্তু সংস্কার চাপিয়ে দেওয়ার পথে হাঁটেনি।

বরং, বিচারপতি খেহর ও বিচারপতি নজির মোক্ষম বলটি ফেরত পাঠিয়েছেন সরকারের কোর্টে। প্রশ্ন করেছেন, যেটা নিজেদের দায়িত্ব, তার জন্য সরকার আদালতের মুখাপেক্ষী কেন? অর্থাৎ, মুসলিম পার্সোনাল ল’তে যদি সংস্কার করতেই হয়, তা করতে হবে দেশের আইনবিভাগকে। সংসদীয় পথে। ‘বাইরে থেকে সংস্কার’-এর তত্ত্বে সবচেয়ে বড় ধাক্কা এখানেই। সংসদে বিল আনা এবং আইন পাশ করিয়ে নেওয়া শুধু দুই কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার প্রশ্ন নয়। সংসদে বিল পেশ করার অর্থই হল, তাকে আলোচনার জন্য খুলে দেওয়া। এবং, সেই আলোচনা মানেই মুসলমান সমাজের ভিতরের যুক্তিগুলো উঠে আসবে প্রকাশ্যে। আলোচিত হবে তাদের আশঙ্কা, অনিশ্চয়তার কথা। মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ কেন অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বদলে শরিয়তি আইনই চান, সেই কথা উঠে আসবে। সে যুক্তি মানতেই হবে, তা নয়, কিন্তু শুনতে হবে। আলোচনা করতে হবে। যুক্তির পরিসরে গায়ের জোরে রাষ্ট্রের অবস্থানকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। অবশ্য, সব কথাকে অগ্রাহ্য করেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আইন পাশ করিয়ে নিতে পারেন মোদীরা, কিন্তু তাতে একটা খামতি থেকে যাবে— সে আইনের নৈতিক বৈধতা থাকবে না। ওটা যে সংখ্যালঘুদের ওপর বিজেপি-র রাজনৈতিক গা-জোয়ারি, তা লুকোনো অসম্ভব হবে। মোদীরা সম্ভবত সে সংস্কারের পথে হাঁটবেন না।

পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ তিন তালাকের প্রশ্নটিকে সহমত হতে পারলেন না, দু’জনের মতের বিরুদ্ধে বাকি তিন জনের মত অনুসারে রায় ঘোষিত হল— সেখানেই কি প্রতিষ্ঠিত হল না একটা বিশেষ অবস্থান? আদালত তিন তালাককে নিষিদ্ধ করল, এবং একই সঙ্গে জানিয়ে দিল, মুসলিম পার্সোনাল ল’-কে প্রশ্ন করতে হলে তা করতে হবে গণতন্ত্রের পরিসরেই। অর্থাৎ, সংখ্যালঘুর ধর্মাচরণের অধিকারটিকে খর্ব না করেই ধর্মীয় সমর্থনহীন কুপ্রথাটিকে ছেঁটে দেওয়া হল। বলা প্রয়োজন, ধর্মই একটি সম্প্রদায়ের প্রধান নিয়ন্ত্রক হবে কি না, এটা সেই বিচারের প্রশ্ন নয়। যে কোনও উদারপন্থীই সেই নিয়ন্ত্রণকে অতিক্রম করার কথা বলবেন। এখানে প্রশ্ন হল, অতিক্রম করার সিদ্ধান্তটি কে নেবে? সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, সেই অধিকার শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার। সেই প্রক্রিয়া কিন্তু শুরু হয়েছে। তিন তালাকের বিরুদ্ধে মুসলমান সমাজের ভিতর থেকে যত স্বর উঠে এসেছে, তা অভূতপূর্ব। আদালতের যে রায়ের সমস্ত কৃতিত্ব দখল করে নিতে বিজেপি উদগ্রীব, ভুললে চলবে না, সেই মামলাটি কিন্তু পাঁচ জন মুসলমান মহিলার দায়ের করা।

আদালতের রায় নিয়ে মোদী-শাহরা যতই উচ্ছ্বসিত হোন, এই রায় তাঁদের পক্ষে নয়। বরং, এই রায় অম্বেডকরের অবস্থানের পক্ষে, যিনি জানতেন, কোনও সম্প্রদায়ের নিজস্ব যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে তার ওপর রাষ্ট্রের মতামত চাপানো যায় না। এই রায় নেহরুর অবস্থানের পক্ষেও, যিনি জানতেন, সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করার জন্য, রাষ্ট্রকে বিশেষ ভাবে যত্নশীল হতে হয়। সেই যত্নের অর্থ তোষণ নয়। যত্নের মোড়কে যাবতীয় কুপ্রথা লুকিয়ে রাখা নয়। বরং, যত্নশীল হওয়া মানে, বিতর্কের পরিসরগুলি খুলে দেওয়া। সংখ্যালঘু সমাজের মধ্যেকার স্বরগুলিকে শোনা, গুরুত্ব দেওয়া, প্রয়োজনে দিকনির্দেশ দেওয়াও। দেশের বহুত্ব-কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই যত্নের কোনও বিকল্প নেই।

মোদীর ভারতেও যখন এই রায় দেওয়া সম্ভব হয়, তখন তাকে ‘ঐতিহাসিক’ না বলে উপায় কী?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE