মু খ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলিয়াছেন, সুপার এমার্জেন্সি। অতিরেকটি যদি-বা না-ও মানা হয়, জরুরি অবস্থার সঙ্গে মোটের উপর একটি তুলনা টানা যাইতেই পারে। পদ্মাবতী-কাণ্ড চোখে আঙুল দিয়া বুঝাইয়া দিয়াছে, এ দেশে ভাবপ্রকাশের মুক্ত বাতাবরণ অনুপস্থিত। এখানে একটি মনগড়া সিনেমার গল্পের সামান্য প্রীতি-দৃশ্যের প্রেক্ষিতে সিনেমার পরিচালক ও অভিনেত্রীর মাথার দাম দশ কোটি হাঁকা হইয়া থাকে, এবং দেশের শাসক দলের পদান্বিত সদস্য নিজেই প্রকাশ্য দিবালোকে সেই দাম হাঁকিতে পারেন। ভারতে এমন ঘটনা অভূতপূর্ব, সুতরাং ঐতিহাসিক, এই সম্পাদকীয় স্তম্ভ গত কালই তাহা বলিয়াছে। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা না বলিলেই নয়। জরুরি অবস্থার তুলনা টানা হইলেও, মনে রাখিতে হইবে যে তেমন কোনও প্রত্যক্ষ ঘোষণা কিন্তু এখনও সরকারের তরফে শোনা যায় নাই। সে ক্ষেত্রে, অবস্থাটিকে এতখানি জরুরি করিয়া তুলিবার পিছনে কি কেবল শাসক সমাজ? না কি বিরোধী সমাজের নীরবতাও এখানে বিরাট ভূমিকা পালন করিতেছে? কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জনতার মাঝখানে আসিয়া এই ভাবে এক শিল্পীর মাথা কাটিবার উসকানি দিলে গোটা দেশের উত্তাল হইয়া উঠিবার কথা ছিল। সমস্বরে প্রতিবাদ জানানোর কথা ছিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সরকারি পক্ষকে চাপিয়া ধরিবার কথা ছিল। প্রধানমন্ত্রী কেন একটিও ভর্ৎসনামূলক শব্দ মুখ হইতে বাহির করিলেন না, সেই কৈফিয়ত চাহিবার কথা ছিল। হরিয়ানার বিজেপি তাহাদের সদস্যের এই কটূক্তির পর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করুক, এই দাবিতে সরব হইবার প্রয়োজন ছিল। এ সবের কিছুই দেখা গেল না। বিরোধীদের দেখিয়া মনে হইল, এ বিষয়ে মুখ খুলিয়া তাঁহারা রাজপুত ভাবাবেগ আহত করিতে চান না।
ইহা নিছক আশঙ্কা নহে। শশী তারুরের কল্যাণে আপাতত ইহা তথ্যভিত্তিক প্রমাণ। তারুর পদ্মাবতী-বিরোধিতার প্রবল নিন্দা করিবার পরই বেগতিক দেখিয়া পশ্চাদপসরণ করিয়াছেন, এবং বলিয়াছেন কাহারও ভাবাবেগে আঘাত করা তাঁহার লক্ষ্য নয়। একটি কথা তাঁহারা ভুলিয়া যাইতেছেন। গুন্ডামির ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দিয়া ও জনভোট রক্ষা করিবার অত্যধিক উদ্বেগ দেখাইয়া তাঁহারা শাসক দলের প্রযত্নে রচিত এই অসহিষ্ণু-রাজের বাড়বৃদ্ধি আটকাইবার যথেষ্ট চেষ্টা করিতেছেন না। এই স্বল্পমেয়াদের সমঝোতা কিন্তু শাসক দলের গ্রহণযোগ্যতাকেই বাড়াইতেছে। তারুর বরং বলিতে পারিতেন যে, পদ্মাবতী যদি বা কোনও জনসমাজের ভাবাবেগকে আহত করিয়াও থাকে, তবু শিল্পের স্বাধীনতার খাতিরে বিষয়টি লইয়া এত বাড়াবাড়ির দরকার নাই। যাঁহারা দেখিতে চাহেন দেখিবেন, অনাগ্রহীরা দেখিবেন না। বিষয়টি এতটাই সরল।
রাজনীতির সমাজের বাহিরেও একটি সমাজ থাকে, যাহার নাম কিছু কাল যাবৎ দাঁড়াইয়াছে— নাগরিক সমাজ। বিস্ময়ের ব্যাপার, সেই সুশীল নাগরিক সমাজ এই ঘটনায় অতীব সুশীল, অর্থাৎ নীরব। যাহা কিছু প্রতিবাদ, সোশ্যাল মিডিয়ার নিরাপদ চত্বরেই সীমাবদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মেরুদণ্ড সোজা রাখিয়া যে কথাটি পরিষ্কার বলিয়াছেন, চলচ্চিত্র জগতের সেই এককাট্টা প্রতিরোধও কিন্তু ইতিমধ্যে দৃষ্ট কিংবা শ্রুত হয় নাই। বিস্তীর্ণ নাগরিক সমাজের অকারণ ভয়, আলস্য, অনীহা দিয়া তবে এই ভাবেই অবস্থাকে ক্রমশ ‘জরুরি’ করিয়া তোলা সম্ভব! ভারতের গণতান্ত্রিক সমাজের সত্তর বৎসর বয়স হইল। তবু এইটুকু নাগরিক সক্রিয়তার পরিবেশ অর্জিত হইল না। রাজনীতির সমঝোতার পাশাপাশি অ-রাজনৈতিক সমাজের এই সুবিধাবাদী নীরবতা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। ভোটের অধিকারের সহিত সমালোচনা ও প্রতিবাদের দায়িত্বও যে গণতন্ত্র নাগরিকের জিম্মায় রাখিয়াছে, তাহা কি এ দেশ ভুলিতে বসিয়াছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy