এক বিখ্যাত চিত্র-পরিচালক, যিনি হিংসা লইয়া বেশ কিছু ছবি করিয়াছেন, সাক্ষাৎকারে বলিয়াছিলেন, তাঁহাকে যাহা সর্বাধিক ভাবায়, তাহা হইল: অকারণ হিংসা। যে হিংসার কোনও রূপ ভিত্তি বা প্ররোচনা নাই। পরিচালকের এক ছবিতে দুইটি যুবক ঘুরিয়া ঘুরিয়া বহু পরিবারকে খুন করে। তাহারা পরিবারগুলির গৃহ হইতে কোনও বস্তু চুরি করে না, পরিবারের কোনও সদস্যের সহিত তাহাদের কোনও পূর্ব-পরিচিতি নাই, ইহা কোনও প্রতিশোধেরও কাহিনি নহে, সমগ্র ছবিতে তাহাদের কাজের কোনও উদ্দেশ্যই খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। পরিচালকের অপর এক ছবিতে এক কিশোর, তাহার সহিত সেই দিনই পরিচয় হওয়া এক কিশোরীকে হত্যা করে ও তাহার শরীর কয়েক খণ্ডে কর্তিত করিয়া, ফ্রিজে লুকাইয়া রাখে। সেই কিশোরীর সহিত তাহার কোনও কলহও হয় নাই, প্রেমও ঘটে নাই। এই সব ঘটনা যত ক্ষণ তথাকথিত ‘আর্ট ফিল্ম’-এ উদ্যাপিত হয়, তাহা লইয়া অনেকে মিলিয়া গভীর তাত্ত্বিক আলোচনা সারিয়া, নিজ নিজ বিদ্যাবত্তায় মুগ্ধ হইয়া বাড়ি ফিরিয়া যাওয়া চলে, কিন্তু বাস্তবে এই প্রকারের ঘটনা ঘটিলে, মানুষের অস্বস্তি বাড়িয়া যায় শত গুণ। কারণ মানুষ সর্বদা যে কোনও কার্য ঘটিলে তাহার কারণ খুঁজিতে চাহে, ইহা তাহার অন্যতম প্রধান প্রবৃত্তি। আমেরিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসে ভয়াবহতম বন্দুক-হামলাটি মানুষকে এই প্রকাণ্ড অস্বস্তিতে ফেলিয়াছে। স্টিফেন প্যাডক এক বয়স্ক ধনী অবসরপ্রাপ্ত মানুষ। লাস ভেগাসে তাহার এই হত্যালীলার কারণ কী, পুলিশ ভাবিয়া বাহির করিতে পারিতেছে না। প্যাডকের ব্যক্তিগত জীবন, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক আচরণ, আর্থিক পরিস্থিতি— সমস্ত কিছু লইয়া বিশ্লেষণ চলিতেছে। কোনও কিছুতেই এই রূপ হিংস্র হইয়া উঠিবার কোনও প্রণোদনার সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না। তাহার কোনও ডায়েরি বা আত্মহত্যা-চিরকুটও পাওয়া যায় নাই, তাহার বহু দিনের সঙ্গিনীও এই বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও আলোকপাত করিতে পারেন নাই। কেহ চিন্তাব্যয় না করিয়া বলিয়া দিতেছেন, লোকটি পাগল। কিন্তু কোনও উন্মাদ মানুষ এমন জটিল নিখুঁত বহুস্তর বহুদিনব্যাপী পরিকল্পনা করিতে পারে না।
প্যাডক গত ১৩ মাস ধরিয়া ৩৩টি বন্দুক ক্রয় করিয়াছে, তাহাদের কয়েকটিকে প্রায় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে পরিবর্তিত করিবার জন্য উপযুক্ত মেরামতি করিয়াছে। হোটেলে সে ২৪টি অস্ত্র ও বহু গুলিবারুদ ১০টি সুটকেসে করিয়া নিজ কক্ষে লইয়া গিয়াছে, প্রহরা এড়াইয়া। খুব সম্ভব সে আরও কিছু উৎসবস্থলের পার্শ্বস্থ হোটেলের খোঁজ চালাইতেছিল, হত্যার উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের জন্য। সঙ্গিনীকেও সে ছক কষিয়াই এই সময় দেশের বাহিরে পাঠায়, যাহাতে এই কার্যের ফলে তাহাকে না দোষী সাব্যস্ত হইতে হয়। তাহার অর্থ এই পরিকল্পনা বহু দিনের, এবং তাহার প্রতিটি ধাপ সুচিন্তিত। এমন ভাবনাচিন্তা করিয়া কাজ যে-লোক করে, সে কোনও হেতু ব্যতীত এমন পৈশাচিক কাণ্ড ঘটাইবে, ইহা প্রায় অচিন্তনীয়। এফবিআই-এর এক ডেপুটি ডিরেক্টর বলিয়াছেন, অতীতে এমন কাহারও সম্পর্কে তাঁহাদের তদন্ত করিতে হয় নাই। মানুষ অবোধ শিশুর দুষ্টামি দেখিয়াও প্রথম প্রশ্ন করে, ‘কেন করিলে?’ এত বড় অপরাধীর ক্ষেত্রে তো তাহা করিবেই। সাধারণত ব্যক্তিটিকে খুঁজিয়া পাইলে, তাহার কাজের উদ্দেশ্য অধিক ক্ষণ গোপন থাকে না। তাহার কম্পিউটার ঘাঁটিয়া ও আত্মীয়-বন্ধুদের জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া সহজেই জানা যায়, সে অমুক হতাশা বা তমুক জিঘাংসা হইতে কাজ করিয়াছে। কখনও সে নিজেই সচেতন ভাবে সেই সূত্র রাখিয়া যায়। কিন্তু হিংসা-অধ্যুষিত আমেরিকাতেও, সকল পুলিশ, সকল মনোবিদ, সকল সমাজ-বিশ্লেষক এই বার থম মারিয়া গিয়াছেন। যাহার টাকার অভাব নাই, জীবনে কোনও পূর্ব-অপরাধের কাহিনি নাই, আপাত ভাবে কোনও অশান্তি নাই, কোনও জঙ্গি দলের সহিত সম্পর্ক নাই, তাহার অকস্মাৎ এতগুলি লোককে খুন করিবার কী দায় পড়িল? কেন সে এত দিন ধরিয়া এমন একটি কাজের প্রস্তুতি লইবে, যাহার অন্তিম অঙ্কে তাহার নিজের জীবন চলিয়া যাইবার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত? মানুষ অতি বিকৃত মনোবৃত্তিও কল্পনা করিতে পারে, কিন্তু অন্তঃসংগতিহীন কাজের ধারণা লালন করিতে পারে না। সকল শোক সহিয়া লইতে পারে, কিন্তু উত্তর না পাওয়া সহ্য করিতে পারে না। প্যাডক কেবল কয়েকটি নিরীহ মানুষকে মারে নাই, সে সমগ্র বিশ্বের যুক্তিনির্ভর ও কৌতূহল-নির্ভর যাপনকেও প্রবল মার মারিয়াছে।
যৎকিঞ্চিৎ
সৌদি আরবের রাজার ব্যক্তিগত বিমানে লাগোয়া খাঁটি সোনার এসকালেটর আচমকা থেমে গেল! সোনা দিয়ে যে তৈরি, সে লক্ষ্মীসোনার মতো ব্যবহার না করলে কেমন মেজাজটা গরম হয়! রাজা অবশ্য কিছু বলেননি, কিন্তু খানকতক গর্দান তো নেওয়াই উচিত! এর চেয়ে আমাদের দেশ কত ভাল, লোহার তৈরি এসকালেটর খারাপ হয়, প্লাস্টিকের তৈরি ডিমে শরীর টসকায়। দামি জিনিসে তৈরি উড়ালপুল পড়ে গেলে আরও কত আপশোস হত! গরিব হওয়ার স্বস্তিই আলাদা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy