যে পূর্বজ বলিয়াছিলেন ‘অধিকন্তু ন দোষায়,’ কালের সাগর পাড়ি দিয়া আশ্বিনের কলিকাতায় পৌঁছাইলে তিনি কান-নাক মলিয়া ভুল স্বীকার করিতেন। আধিক্য ভয়ঙ্কর, এ শহর তাহার দৃষ্টান্ত। যাহা ছিল চার দিনের দুর্গোৎসব, তাহা পনেরো দিনের উন্মত্ত উদ্যাপনে পরিণত হইয়াছে। পিতৃপক্ষ না-কাটিতে পূজার উদ্বোধন, দ্বিতীয়া না-লাগিতে দিবারাত্র মাইকবাদন, তৃতীয়ার সন্ধ্যায় রাস্তায় মহাসপ্তমীর জনস্রোত। স্কুল-কলেজ খোলা থাকিতেই ছেলেমেয়েরা পড়া ভুলিয়াছে, দফতরে বড়রা ভুলিয়াছে কাজ। শপিং মল, রেস্তোরাঁ ও মদের দোকানের সম্মুখে ভিড় উপচাইয়া পড়িতেছে। যেন একটাই উদ্বেগ গোটা শহরটিকে তাড়াইয়া ফিরিতেছে, যদি সিকিটাক আহ্লাদ, পোয়াটাক আমোদ বাকি রহিয়া যায়? ভূরিভোজ কিংবা ভূরিদর্শন, কোনও একটিতে যদি প্রতিবেশী বা বন্ধুদের হইতে অর্ধপদও পিছাইয়া পড়িতে হয়? সেই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা খারিজ করিতে বিচিত্র পরিধান ও পাদুকার সচল বিজ্ঞাপন সাজিয়াছে শহরবাসী। প্রমোদে মন ঢালিয়া তাহারা অর্ধমাস রাস্তায় বিচরণ করিবে। এই লাগামহীন গণ-উদ্যাপনে সংযম, সৌজন্যের এতটুকু স্থান নাই। শব্দাসুর নিরবচ্ছিন্ন ভাবে জনপ্রিয় সংগীতের রূপ ধরিয়া দুই কান মর্দন করিতেছে। আলোকাসুর গাছের গা পেঁচাইয়া, চাঁদোয়া হইয়া ঝুলিয়া, অদ্ভুতদর্শন তোরণে নানা বিসদৃশ চিত্র সৃষ্টি করিয়া চক্ষুপীড়ার কারণ হইতেছে। যানজটে পথ স্তব্ধ, অর্ধেক রাস্তা যানবাহনের অগম্য, রাজপথ হাঁটিবার অযোগ্য। সকল ইন্দ্রিয়কে পীড়িত না করিয়া কি উৎসব করা যায় না?
অনেকে আপত্তি করিবেন, বৎসরে কয়েক দিন বই তো নয়। একটু বাড়াবাড়ি হইলেই বা দোষ কী? আধিক্যের দোষ কোথায়, তাহা বুঝিয়াছিলেন রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎ। ব্রহ্মাস্ত্র ছুঁড়িয়া তিনি হনুমানকে অচল করিয়াছিলেন, কিন্তু রাক্ষসরা সেই দৈব অস্ত্রের উপর দড়ি বাঁধিয়াছিল। তাহাতে ব্রহ্মাস্ত্রের বন্ধন আলগা হইয়া গেল, বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী অস্ত্র ব্যর্থ হইল। দেবীপক্ষ লইয়া বাড়াবাড়ি সেই ভাবেই তাহার মৌলিক অর্থের বিনাশ করিতেছে। পিতৃপুরুষের তর্পণের তিথি মহালয়া। শোক ও স্মরণের এই দিনটিতে এখন সকলে অবাধে ‘শুভেচ্ছা’ বিনিময় করিতেছে। যাহা কার্যত শ্রাদ্ধদিবসে শুভকামনা জানাইবার শামিল। স্ফূর্তির আধিক্যে মহালয়া অর্থহীন হইয়া গেল। বিভিন্ন পূজা কমিটির আধিক্যের নেশা দেখিলেও তেমনই অর্থহীনতার বোধ হয়। যিনি ত্রিভুবনেশ্বরী, তাঁহাকে ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ দুর্গা’ বলিয়া বিজ্ঞাপন দিতে কি কাহারও বুক কাঁপে নাই? যাঁহাকে কুবের-সহ সকল দেবতা অকল্পনীয় ঐশ্বর্যে ভূষিত করিয়াছিল, তাঁহার আট কোটি টাকার শাড়ি দেখিবার জন্য কেহ আহ্বান করিতেছে। কেহ আসল হিরা-জহরতে মূর্তি সাজাইবার সগর্ব প্রচার করিতেছে। তবে বুঝি দেবী গৌণ, গয়না-শাড়ি দেখিবারই আমন্ত্রণ?
হয়তো আজ এই আক্ষেপ অর্থহীন। গ্রামের আটচালাটি ছাড়িয়া দেবী যে দিন শহুরে নব্য-ধনী, কোম্পানির দালাল জমিদারদের বাড়ি পদার্পণ করিয়াছেন, তখন হইতেই তাঁহার পূজায় ভক্তির প্রকাশের চাহিতে ভক্তের প্রতিপত্তির প্রচার বেশি গুরুত্ব পাইয়াছে। বিশেষত বিদেশি প্রভুদের তারিফ আদায় করিতে সে যুগে জমিদাররা নানা চমকপ্রদ আমোদ-আহ্লাদের আয়োজন করিতেন। তে হি নো দিবসা গতাঃ। এখন রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা ‘সর্বজন’কে সম্মুখে রাখিয়া নিজ নিজ ক্ষমতার আস্ফালন করিতেছেন। তাঁহাদের খাজাঞ্চি বহুজাতিক সংস্থা। প্রতিদ্বন্দ্বিতা রহিয়াছে, বদলাইয়াছে প্রতিদ্বন্দ্বী। অতএব প্রতিমার গায়ে হিরা-জহরত, মণ্ডপসজ্জা, সঙ্গীত ও সুরাপান, সকলই উত্তরোত্তর বাড়িবে। বাকি কেবল বাইনাচ। অচিরে তাহাও আর বাড়াবাড়ি বলিয়া মনে হইবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy