অধিকার-অনধিকারের প্রশ্ন যে হিন্দুসমাজে রক্তক্ষয়ী বিভেদের উৎস হইয়া উঠিতে পারে, সেই প্রাচীন সত্যের নূতন প্রকাশ ঘটিল গুজরাতে। আনন্দ জেলার ভদ্রানিয়া গ্রামে খুন হইলেন এক দলিত যুবক। তাঁহার অপরাধ, গত রবিবার এক মন্দিরের প্রাঙ্গণে তিনি এবং আরও কয়েক জন দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ গরবা নৃত্যের অনুষ্ঠান দেখিতেছিলেন। অনুষ্ঠানটি ছিল উচ্চতর বর্ণের পটেল সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষদের। তাঁহাদের নৃত্য দেখিবার অধিকার দলিতদের নাই— এই অভিযোগে তাহাদের কয়েক জন ওই চার জনের উপর চড়াও হয়, প্রবল প্রহার করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারের পরিসর নির্দিষ্ট করিয়া দিলেও হিন্দু ভারত তাহা মানিতে নারাজ। সেই সমাজের স্বনিযুক্ত অভিভাবকরা স্থির করিয়া দিয়াছে, উৎসবে দলিত যুবার প্রবেশাধিকার নাই। ভারত নামক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে হিন্দুত্ববাদের দাপটে সেই প্রাচীন সমাজের অন্তরে নিহিত ভয়ানক বিদ্বেষের উৎকট উপসর্গগুলি ক্রমশ প্রবল হইয়া উঠিতেছে। যে উপসর্গগুলি আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ, পালে অনুকূল হাওয়া পাইলে তাহারা দাঁত-নখ লইয়া ‘অপর’কে আক্রমণ করিবে। নিরামিষ না খাইবার অপরাধে হয়তো দিনবিশেষে নাগরিকের গর্দান যাইবে।
এই বিভেদবুদ্ধিকে আঘাত করিবার অস্ত্র কিন্তু হিন্দুধর্মের মধ্যেই নিহিত আছে। হিন্দুত্ববাদীরা স্বীকার না করিলেও সত্য ইহাই যে, হিন্দুধর্মের নানা রূপ। উচ্চবর্ণের অহমিকায় গুজরাতে যাহারা দলিত হত্যা করিয়াছে, আইনের পথে তাহাদের সুবিচার হইবে কি না, তাহার কোনও নিশ্চয়তা নাই। কিন্তু বর্ণগর্বিত এই ঘাতককুল ও তাহাদের সহমর্মীদের, যাহারা জাতের নামে হত্যা করে নাই কিন্তু সময়-সুযোগ পাইলেই করিতে পারে, এক ‘হিন্দু সন্ন্যাসী’র কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাইতে পারে। স্বামী বিবেকানন্দ লিখিয়াছিলেন, ‘‘ভারতের চিরপদদলিত শ্রমজীবী, তোমাদের প্রণাম করি।’’ লিখিয়াছিলেন, ‘‘আর্য্যবাবাগণের জাঁকই কর, প্রাচীন ভারতের গৌরব ঘোষণা দিনরাতই কর, আর যতই কেন আমরা ‘ডম্ম্ম্ম্’ বলে ডম্ফই কর, তোমরা উচ্চবর্ণেরা কি বেঁচে আছ?’’ বর্ণব্যবস্থার বিভেদ-বিদ্বেষ যে ভারতকে দীর্ণ করিতেছে, বিবেকানন্দ তাহা বিলক্ষণ বুঝিয়াছিলেন। ‘জেলে, মালা, মুচি, মেথরের’ ঝুপড়ির মধ্য হইতে নূতন ভারতের প্রকাশ হউক, ইহাই ছিল তাঁহার অভিপ্রায়।
বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের সীমাকে প্রসারিত করিতে চাহিয়াছিলেন। মহাত্মা গাঁধীও হিন্দুর ধর্মে অবিশ্বাসী ছিলেন না, কিন্তু তিনিও হরিজনদের অধিকার লইয়া সরব হইয়াছিলেন। হিন্দুধর্মের এই সম্প্রসারিত রূপ মানুষের অধিকারকে সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠা প্রদানে সহায়তা করিবে। কিন্তু সমাজ কবে সংশোধিত হইবে, রাষ্ট্র সেই ভরসায় বসিয়া থাকিতে পারে না। ভারত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আম্বেডকর ছিলেন এই রাষ্ট্রের সংবিধানের রূপকার। নিজের জীবন দিয়া তিনি অনুভব করিয়াছিলেন, জাতপাতের বিভেদ কত মর্মান্তিক হইতে পারে। ছাত্রাবস্থায় উচ্চবর্ণের ঘৃণার শিকার হইয়াছিলেন তিনি। ভারতীয় সংবিধান নাগরিকদের যে অধিকার প্রদান করিয়াছে তাহা শিরোধার্য। জাতের নামে ধর্মের নামে হত্যাকারীদের আইনানুগ শাস্তি বিধেয়। তাহাদের রাজনৈতিক গোত্র যাহাই হউক না কেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy