বর্ধমানে ভামিনীরঞ্জন সেনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: জয়রঞ্জন সেনের সৌজন্যে
স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল দেশ। বর্ধমানের রাজা তখন বিজয়চাঁদ মহতাব। তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু দেশব্রতীদের জন্য তাঁর সাহায্যের হাত ছিল অবারিত। সেই সময় নানা কর্মসূচিতে বর্ধমানে এসেছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে জওহরলাল নেহরু— সকলেই। সুভাষচন্দ্র বসু বর্ধমান শহরে এসেছিলেন মোট চার বার। তার মধ্যে অন্তত দু’টির কথা বর্ধমানের বহু প্রবীণ নাগরিকের স্মৃতিতে আজও অম্লান।
সালটা ১৯৩৮ বা ১৯৩৯। সুভাষচন্দ্রকে প্রথম দেখেন তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র কালীপদ সিংহ। পরে তিনি বর্ধমান রাজ কলেজে বাংলার শিক্ষকতা করতেন। তাঁরা কয়েক জন ছাত্র, সে দিন বর্ধমানে ছিলেন। কালীপদবাবুর স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, সে দিন নেতাজি প্ল্যাটফর্মেই নামতেই তাঁরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন নেতাজিকে। সেই সময়ে বর্ধমান তো বটেই, বাংলার অধিকাংশ ছাত্র ও যুবকের নয়নের মণি সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর বক্তৃতা শুনতে নানা প্রান্ত থেকে মানুষ হাজির হয়েছিলেন শহরে। কালীপদবাবু তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ‘‘নেহরু এবং নেতাজি দু’জনের বক্তৃতার ধরনটা ছিল ভিন্ন গোত্রের। সুভাষ বক্তৃতা করতেন ধীরে ধীরে। মনের ভিতর থেকে কথাগুলোকে তুলে আনতেন যেন। কিন্তু নেহরু বক্তৃতা দিতেন ঝড়ের মতো।’’ কালীপদবাবুর স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, বর্ধমানের একটি জনসভায় নেতাজি বলেছিলেন, ‘‘ওই যে দেওয়াল রয়েছে, দেওয়াল একটা বড় শক্তি। একা আমরা ভাঙতে পারি না। কিন্তু আমরা সবাই যদি দেওয়ালটাকে চেপে ধরি তা হলে দেওয়ালটা ঠিকই পড়ে যাবে। তেমনই ব্রিটিশ রাজশক্তি যতই শক্তিশালী হোক, আমরা সবাই যদি তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করি, নিশ্চয়ই এক দিন তাকে ভেঙে পড়তে হবে।’’ স্মৃতি হাতড়ে কালীবাবু বলেছেন, ‘‘নেহরু আবেগপ্রবণ ভাবে হাত নেড়ে নেড়ে উত্তেজনার মুখে দ্রুত কথা বলে যেতেন। কিন্তু সুভাষ বলতেন স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে। যুক্তির পরে যুক্তি সাজিয়ে।’’ কালীপদবাবুর বক্তব্য থেকে জানা যায়, এই বর্ধমানের মাটিতে দাঁড়িয়ে একটি সভায় নেতাজি বলেছিলেন, ‘‘পরাধীনতা পাপ, পরাধীনতা স্বীকার করা মহাপাপ।’’ কিন্তু সেই সভা কোথায় এবং কবে হয়েছিল সে প্রসঙ্গে তাঁরা কিছু বলে যাননি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান ও নানা বইপত্র থেকে জানা যায় এর পরে সুভাষচন্দ্র বসু বর্ধমানে এসেছিলেন ১৯৪০ সাল নাগাদ। সম্ভবত সেটাই ছিল তাঁর শেষ বর্ধমানে আসা। সে বারে এসেছিলেন বেশ কিছু কাজ নিয়ে। এসে উঠেছিলেন ভামিনীরঞ্জন সেনের বাড়িতে। ১৯৮৪ সালে ভামিনীরঞ্জন সেনের নাতি আইনজীবী দেবরঞ্জন সেনের একটি সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছিল নেতাজির সে বারের বর্ধমান আগমনের নানা প্রসঙ্গ। সেই সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ১৯৪০ সালে সুভাষচন্দ্র যখন সেন বাড়িতে আসেন, তখন দেবরঞ্জনবাবু ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তিনি বলেছিলেন, ‘‘বর্ধমানের মহারাজা স্যর বিজয়চাঁদের খুব সুন্দর সাজানো দু’ঘোড়ায় টানা সেই ঐতিহাসিক জুড়িতে চেপে কংগ্রেস নেতা সুভাষচন্দ্র বর্ধমান স্টেশন থেকে সোজা নামলেন আমাদের এই প্রকাণ্ড বাড়ির সামনে।’’
এই স্মৃতিকথা থেকে আরও জানা যায়, সেন বাড়ির গৃহকর্ত্রী, ভামিনীরঞ্জন সেনের স্ত্রী সরোজিনীদেবী সুভাষচন্দ্রের কাছে ছিলেন মাতৃসমা। নেতাজি বাড়িতে ঢুকে সবার প্রথমে তাঁর সঙ্গেই সাক্ষাৎ করেছিলেন। সুভাষচন্দ্রকে বুকে জড়িয়ে ধরে সরোজিনী দেবী প্রশ্ন করেন, ‘‘এত রোগা হয়ে গিয়েছিস কেন রে?’’ সুভাষচন্দ্র এই বাড়িতেই রাত কাটিয়ে ছিলেন। বৈঠক করেছিলেন কংগ্রেস কর্মীদের সঙ্গে। পুরসভার কমিশনারের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সে বার তিনি বর্ধমানের কালীবাজারে পাইওনিয়ার ব্যাঙ্কের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে এই ব্যাঙ্কটির এখন আর কোনও অস্তিত্ব নেই।
সেই সময়ে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে একটি ঘটনার সূত্রে জড়িয়ে গিয়েছিলেন বর্ধমানের গোবিন্দচন্দ্র নাগ। পেশায় মিষ্ঠির ব্যবসায়ী গোবিন্দবাবুর সঙ্গে শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সুবোধ মুখোপাধ্যায়, বামাপতি ভট্টাচার্যের মতো শহরের বেশ কয়েক জন প্রভাবশালী লোকের চেনা জানা ছিল। সেই সুবাদেই তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর কাছে। গোবিন্দবাবু ১৯৪০ সালের ২৩ জানুয়ারি তাঁর প্রিয় নেতার জন্মদিনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নেতাজি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ নামে একটি দোকানের। তার কিছু দিনের মধ্যেই নেতাজি স্বয়ং বর্ধমানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। যাচ্ছিলেন বিসি রোড ধরে। তখন গোবিন্দবাবু এগিয়ে এসে নেতাজিকে তাঁর মিষ্টির দোকানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সুভাষচন্দ্র অনুরোধ রক্ষা করেন।
এর পরে বদলে গিয়েছিল গোবিন্দবাবু ওরফে ‘কালোদা’-র জীবন। প্রতি বছর নেতাজির জন্মদিনে দরিদ্র মানুষদের মধ্যে মিষ্টি বিলি শুরু করেন গোবিন্দবাবু। তার পরে কেটেছে অনেকটা সময়। সে দোকান এখন পাকা হয়েছে। আজও, ২৩ জানুয়ারির সকালে দরিদ্র মানুষজনের মধ্যে লাড্ডু বিতরণ করেন গোবিন্দবাবুর একমাত্র কন্যা রমাদেবীর পুত্র সৌমেন দাস। তিনি জানালেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানের জাঁক হয়তো কিছুটা কমেছে, কিন্তু আন্তরিকতা আজও বহমান।
বর্ধমানের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy