Advertisement
১১ মে ২০২৪
প্রবন্ধ

জনসংযোগের পাঠ না নিলে এমনই হবে

রোগিণীর মৃত্যুতে ক্ষিপ্ত জনতা বেসরকারি হাসপাতাল আক্রমণের পর মোটামুটি তিন রকমের মতামত বাতাবরণে ঘুরছে। প্রথম দলের বক্তব্য, বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে টাকা রোজগারই মুখ্য, রোগীদের পরিষেবা গৌণ।

প্রতীকী চিত্র

প্রতীকী চিত্র

অশোককুমার মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

রোগিণীর মৃত্যুতে ক্ষিপ্ত জনতা বেসরকারি হাসপাতাল আক্রমণের পর মোটামুটি তিন রকমের মতামত বাতাবরণে ঘুরছে। প্রথম দলের বক্তব্য, বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে টাকা রোজগারই মুখ্য, রোগীদের পরিষেবা গৌণ। এরা রোগী বা তাঁর পরিবারকে মানুষ হিসাবেই গণ্য করে না, খারাপ ব্যবহার করে আর ছলছুতোয় বিল বাড়ায়।

আমাদের ক্রেতা সুরক্ষা মন্ত্রী প্রথম দলে: ‘বেসরকারি হাসপাতালগুলো সেবামূলক কাজের কথা ভুলে গিয়ে শুধু ব্যবসা করবে, সেটা বরদাস্ত করা হবে না।’ কেউ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেনি, সেবামূলক কাজের বিনিময়ে টাকা নেওয়াটা যে ব্যবসার মূল, তাকে তিনি কেমন করে বরদাস্ত না করে থাকবেন?

দ্বিতীয় দল হাসপাতালের পক্ষে: বেসরকারি হাসপাতাল এখানে ব্যবসা করতে এসেছে, দানছত্র খুলতে নয়। অতএব রোগীকে যখন সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সে আর তার পরিবারের লোক তো জানেই, সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেশি টাকা লাগবে, তা হলে আবার ক্ষোভ কেন? এঁদেরও কেউ মনে করিয়ে দেয়নি, ব্যবসা মানে কিন্তু অনৈতিক ভাবে লাভ করা নয়।

তৃতীয় পক্ষ আবার অভিজ্ঞ জেঠামশাইয়ের মতো দু’পক্ষকেই দুষেছেন। রোগিণীর মৃত্যু ‘দুর্ভাগ্যজনক’, পরিবারের প্রতি ‘সহানুভূতি’ জানাবার মতো পোশাকি কথা সেরেই বলছেন, এত কিছুর পরেও জনতার ওই রকম সম্পত্তি ভাঙচুর, তাণ্ডব করা ঠিক নয়। আবার হাসপাতালকেও একটু বকে দিয়েছেন— পরিষেবার মান উন্নত করতে হবে। এঁদেরও কেউ বলেনি জনতার স্বতঃস্ফূর্ত উন্মাদনার সঙ্গে বরণীয় লেখক-শিল্পীরা ঝড়, বন্যার তুলনা করে থাকেন, কারণ, প্রকৃতির বিক্ষোভও কোনও নিয়ম মেনে চলে না। মজার কথা হল, ভাঙচুরের পরেই যে পরিষেবার উন্নতির কথা বলা হচ্ছে, তা প্রকারান্তরে ওই রামধোলাইয়ের সার্থকতাই স্বীকার করে নেয়।

রোগিণীর বাড়ির লোকের কথা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য যদি পাশাপাশি রেখে মন দিয়ে লক্ষ করা যায়, সে দিনের সমস্যাটিকে যথার্থ বোঝা যাবে।

নমুনা ১— রোগিণীর বাবা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার (১৪/২) রাতে হাসপাতালে আনার কিছু ক্ষণ পরেই তাঁদের বলা হয়, অপারেশন করতে দেড় লাখ টাকার দরকার। কীসের অপারেশন, তা বলা হয়নি। তাঁরা অনেক চেষ্টা করে চল্লিশ হাজার টাকা জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাবার ধারণা, পুরো টাকা দেওয়া হয়নি বলে চিকিৎসা না করে ফেলে রেখে মেয়েটাকে মেরে ফেললেন ডাক্তারেররা। হাসপাতালের বক্তব্য, মঙ্গলবার রাতে নয়, রোগীকে আনা হয় বুধবার ভোরে। অথচ, হাসপাতাল কর্মীদের একাংশ বলেছেন যে মঙ্গলবার রাতে রোগিণীর পরিবারের লোকেদের রাগারাগি করতে দেখেছেন তাঁরা। রোগিণী যে কখন এসেছে এবং কখন ওই চল্লিশ হাজার টাকা জমা পড়ল তা প্রমাণ করা খুব সহজ। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই দুইয়ের কোনওটিই সাদা-কালো প্রমাণ সহ জানায়নি।

নমুনা ২— হাসপাতাল বলছে, খুব খারাপ অবস্থায় রোগিণীকে আনা হয়েছিল: পারফোরেশন অব বাওয়েল। শক-এ ছিল। রক্তচাপ স্বাভাবিক করার ওষুধ দেওয়া হয়। না হলে, অস্ত্রোপচার করা যাবে না। কিন্তু সব কিছু স্বাভাবিক হওয়ার আগেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। অপারেশন থিয়েটারে যাবার আগেই সব শেষ।

রোগিণী যে এসেইছে খারাপ অবস্থায়, তা কি প্রথম পরীক্ষার পরেই জানানো হয়েছিল রোগিণীর পরিবারের লোকজনকে? হয়ে থাকলে কখন? হাসপাতালের কোনও বক্তব্য শোনা যায়নি এখনও।

রোগিণীর দাদার কথা— রাত বারোটা পর্যন্ত বোনের সঙ্গে কথা বলেছেন। রাতে হাসপাতালেই ছিলেন বাড়ির অনেকে। কিন্তু তাঁদের কাউকেই, দাদার কথামত, রোগিণীর কী হয়েছে, কী পরীক্ষা হচ্ছে, কিছুই জানানো হয়নি। রাত তিনটেয় জানানো হয় রোগিণীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে অস্ত্রোপচার করা যায়নি।

নমুনা ৩— রোগিণীর পরিবারের সঙ্গে যুক্ত নয়, হাসপাতাল চত্বরে থাকা এমন অনেকেরই ক্ষোভ— হাসপাতাল ঠিক করে জানায় না রোগীর কী হয়েছে, বরং তাঁদের খোঁজ, পেশেন্টের মেডিক্লেম আছে কি না!

এমন অভিযোগের বিরুদ্ধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য— তাঁরা দীর্ঘ দিন দক্ষতার সঙ্গে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে আসছেন, এমন অভিযোগ কখনও ওঠেনি। তাঁদের মতে বুধবার সকালের ঘটনা নেহাতই বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাস।

যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায়, হাসপাতাল যা বলছে সব নিখাদ সত্য, তা হলে বলতে হয় ওই ডামাডোলের মধ্যেও রোগিণীর দাদা বেশ হিসেব করে এই মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন সাংবাদিকদের যে, রোগিণী মঙ্গলবার রাত ন’টায় ভরতি হয়েছিল এবং রাত বারোটাতেও বোনের সঙ্গে তিনি যখন কথা বলেছেন, সে ভাল ছিল। আর, হাসপাতাল কর্মীদের একাংশ যে জানিয়েছেন, রাতের কর্তব্যরত ডাক্তার-নার্সরা কোনও প্রশ্নেরই যথাযথ উত্তর না দেওয়ায় উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন রোগিণীর বাড়ির লোকজন, তা-ও অসত্য।

কিন্তু হাসপাতাল যা বলছে সব ষোলো আনা সত্যি বলে মানলেও, ঘটনাপরম্পরা থেকে এটা অন্তত প্রমাণিত, তাঁদের ‘অস্বচ্ছ’ কথায় রোগিণীর পরিবার খুশি নয়। ঠিক ভুল যে কোনও কারণেই হোক, তাঁদের মনে হয়েছে যে, অবহেলা করা হল। এ-ও স্পষ্ট, বেশি টাকা চাওয়ার জন্য তাঁদের যত না ক্ষোভ, তার চেয়ে অনেক বেশি রোগিণী সম্পর্কে ডাক্তার-নার্সদের কোনও সরল-সহজ কথা না বলা। এই জন্যই, বুধবার সকালে তাঁরা বার বার দাবি জানাচ্ছিলেন, সংশ্লিষ্ট ডাক্তারকে তাঁদের হাতে তুলে দেবার। ডাক্তারের ওপর সেই ক্রোধ আছড়ে পড়েছিল আরোগ্যশালার কাচের দরজায় আর হাতের নাগালে পাওয়া কর্মীদের বুকেপিঠে।

কিছু দিন আগে মুম্বইয়ের কয়েকটি বড়-মাঝারি-ছোট মাপের হাসপাতালের ডাক্তারদের কাছে পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল। প্রতিটি জায়গায় ডাক্তারবাবু প্রেসক্রিপশনে ছবি এঁকে বুঝিয়েছিলেন, কী হয়েছে, কী ভাবে অস্ত্রোপচার করা হবে। আন্ধেরির এক বড় মাপের হাসপাতালে গিয়েছি। সঙ্গে মুম্বইয়ের এক ডাব্বাওয়ালা। আমার প্রশ্নের জবাব তো বটেই, তার মতো আনপড়-এর প্রশ্নেরও জবাব ধৈর্য ধরে দিয়েছিলেন পাঁচতারা হাসপাতালের বিলেত ফেরত সেই নামী ডাক্তার। নিজের এবং অধস্তন এক ডাক্তারের মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেছিলেন, আরও প্রশ্ন থাকলে ফোন করতে। তাঁর অধীনস্থ এক গ্রাহক পরিষেবা বিভাগের প্রতিনিধি বুঝিয়েছিলেন, খরচের হিসাব। যা কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালের খরচের মতোই। হয়তো উনিশ-বিশ। ডাক্তারবাবুর সচিত্র ব্যাখ্যায় মুগ্ধ ডাব্বাওয়ালা পরামর্শ দিয়েছিলেন ওই হাসপাতালেই অপারেশন করাতে। আমি নিশ্চিত, ওই ঘটনার পরে সেই আনপড় ডাব্বাওয়ালা আরও পাঁচ জনের কাছে ওই হাসপাতালের গুণ গেয়েছেন। এই ভাবেই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে।

পরে, মুম্বইয়ের সেই হাসপাতালের জনসংযোগ অধিকর্তাকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম, কিছু সময় ধরে তাঁরা সব স্তরে স্বচ্ছতাভিত্তিক এই জনসংযোগ চালু করেছেন। এখন তা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো চলে।

প্রশিক্ষণ না থাকলে, মাটির কাছাকাছি কান না থাকলে যা হওয়ার, তাই হয়েছে কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালটিতে। কর্তারা এমন ভাব করে চলেছেন যে, তাঁদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত! এই আত্মমুগ্ধদের কে বোঝাবে, সত্যিই যদি এমন সুষমানিটোল ভাবমূর্তি থাকত এই সেবা প্রতিষ্ঠানের, তা হলে ‘হঠাৎ কোনও বিচ্ছিন্ন-ব্যতিক্রমী অপদার্থতার কারণে’ বিক্ষুব্ধ মানুষ ইট-পাটকেল ছোড়ার আগে সে দিন দু’বার ভাবত। জনসংযোগ অধিকর্তা, যাঁর নাকি জনতার নাড়ির স্পন্দন বোঝবার কথা, তাঁকে বলতে হত না— আমরা ভীত, আমরা সন্ত্রস্ত!a

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE