Advertisement
১১ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

দু’সপ্তাহ নির্বাচন কমিশনের বড় দায়িত্ব

মমতাদেবীর মরিয়া হওয়ার কারণ একটাই। তিনি জানেন যে, তিনি ক্ষমতা হারালে সব হারাবেন। তৃণমূল কংগ্রেসকে ধরে রাখা যাবে না। তাই তিনি এখন এই সব হুমকি দিচ্ছেন। ঘো ষণা আগেই ছিল, সেই অনুযায়ী নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাসে ‘চড়াম’ ‘চড়াম’ ঢাকের বাদ্যি রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথম দফার পর থেকেই ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাসের খবর ছিল, কিন্তু পঞ্চম ও ষষ্ঠ দফার পর এই সন্ত্রাস অভূতপূর্ব মাত্রা পেয়েছে।

নজরদারি। কলকাতার তিলজলায় ২৯ এপ্রিল, ২০১৬। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য

নজরদারি। কলকাতার তিলজলায় ২৯ এপ্রিল, ২০১৬। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য

অসীম চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

ঘো ষণা আগেই ছিল, সেই অনুযায়ী নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাসে ‘চড়াম’ ‘চড়াম’ ঢাকের বাদ্যি রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথম দফার পর থেকেই ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাসের খবর ছিল, কিন্তু পঞ্চম ও ষষ্ঠ দফার পর এই সন্ত্রাস অভূতপূর্ব মাত্রা পেয়েছে। ৩০ এপ্রিল ষষ্ঠ দফার নির্বাচন হয়েছে আর পর দিন রাত্রি থেকেই যাদবপুর, কসবা, ক্যানিং, ভাঙড়, বাসন্তী, বালিগঞ্জ, আরামবাগ, ধনেখালি, চুঁচুড়া-সহ নানা জায়গা থেকে সন্ত্রাসের খবর আসতে শুরু করেছে। আক্রান্ত হয়েছেন বিরোধী জোটের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। এ বারের সন্ত্রাসের বৈশিষ্ট্য— নেতা-কর্মী-সমর্থকরা না থাকলেও টার্গেট হয়েছে তাঁদের বাড়িগুলি। বৃদ্ধ বাবা-মা, মহিলা সহ বাড়ির লোকজন আক্রান্ত হয়েছেন, রেহাই পায়নি দুধের শিশুটিও।

আক্রান্ত হোন আর না-ই হোন, এই সন্ত্রাস রাজ্য জুড়ে মানুষজনের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। তার আরও কারণ হল, পুলিশের ভোলবদল। পঞ্চম ও ষষ্ঠ দফা ভোটের পর ‘নিজের ভোট নিজে দেওয়া’র আনন্দে আপ্লুত মানুষজন যে পুলিশ বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকাকে কুর্নিশ জানিয়েছিলেন, বিভিন্ন নির্বাচনী সভায় মুখ্যমন্ত্রীর হুমকিতে তাঁদেরই একাংশের পুরনো দলদাসত্বের চেহারা দেখে রাজ্যবাসী উদ্বিগ্ন। হামলার খবর পেয়েও পুলিশ সময়ে আসে না, হামলাকারীরা দাপিয়ে বেড়ালেও কেউই গ্রেফতার হয় না, নামে মাত্র গ্রেফতার হলেও থানা থেকেই ছাড়া পেয়ে যায়, লঘু ধারা দেওয়ার জন্য বা সরকারি উকিলের অনুপস্থিতিতে অনায়াসে জামিন মেলে— মমতা-জমানায় এই চেনা ছবিই আবার দৃশ্যমান হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষজনের উদ্বেগ ও আশঙ্কা এখানেই।

আশঙ্কার আরও কারণ হল, মানুষজন ভাবতে শুরু করেছেন যে, নির্বাচনী ফলাফল যা-ই হোক না কেন, এই সন্ত্রাস ১৯ মে অর্থাৎ নির্বাচনী ফল প্রকাশ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এ রকম কারণ ভাবনার কারণ ত্রিবিধ।

এক, নির্বাচন-পরবর্তী হিংসা রাজ্যে বাম জমানাতেও দেখা গেছে, কিন্তু সেখানে হিংসা ছিল নিয়ন্ত্রিত, হিসেবি, সিলেক্টিভ হিংসা, আর এখানে তা অনিয়ন্ত্রিত, নির্বিচার, মাত্রাছাড়া, চূড়ান্ত। বাম জমানাতে হিংসার রাশ টানার নেতানেত্রীরা ছিলেন। কিন্তু ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই’ রাজত্বে হিংসার রাশ টানার কেউ নেই। ফলে এখানে নির্বাচনী ফলাফল যা-ই হোক, এলাকায় দাপট বজায় রাখা এই সন্ত্রাসের রণনীতিগত লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।

দুই, নির্বাচনের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে এই সন্ত্রাসের যোগাযোগ স্পষ্ট। লক্ষণীয়, নির্বাচন কমিশনের দৃঢ় অবস্থান, কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা, বিলম্বিত হলেও রাজ্য পুলিশের বৃহদংশের দায়বদ্ধতার সঙ্গে মানুষের প্রতিরোধ শাসক দলের ভোটে জেতার চেনা ছককে এলোমেলো করে দিয়েছে। তাই, প্রত্যাশিত ফল যে পাওয়া যাবে না, সেই সত্য ক্রমেই শাসক দলের কাছেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথম দফার ১৮টি আসনের মধ্যে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে যে ৪টি আসনে বাম ও কংগ্রেসের যুক্ত ভোট টিএমসি-র থেকে বেশি ছিল, তা বাদ দিয়ে অন্তত ১৪টি আসনে শাসক দলের জেতার আশা ছিল। কিন্তু এখানে দল ৯টির বেশি আসন পাবে বলে মনে হয় না। দ্বিতীয় দফায় বর্ধমানে ৯টি আসনে ফল জোটের পক্ষে ৫/৪ হতে পারে, পশ্চিম মেদিনীপুরে ১৩টির মধ্যে সম্ভবত টিএমসি-র পক্ষে ৭/৬ হবে। বাঁকুড়ায় ৯টি আসনে জোট ভাল ফল করবে। তৃতীয় দফায় বীরভূমে অনুব্রত যতই ১১/০ করার দাবি করুক, এখানে ফল সম্ভবত জোটের পক্ষে ৬/৫ হবে, ৭/৪ হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় ধাক্কা হবে উত্তরবঙ্গে: এখানে মোর্চা ৩টি আসন জিতবে, কিন্তু শাসক দলের পক্ষে ১টি আসনে জেতাও কঠিন হবে। এই বিস্তর ফারাক কমানোর জন্য শাসক দল অতঃপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছে। কিন্তু পরের নির্বাচন মুর্শিদাবাদ-মালদায় কংগ্রেসের গড়, নদিয়াতেও শাসক দল ছিন্নভিন্ন। অতঃপর পঞ্চম দফায় দুই ২৪ পরগনা, হুগলি, হাওড়া, কলকাতা। এখানে বাহুবলীদের নাকাবন্দি করে সুষ্ঠু নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিশ শাসক দলের সব অংকই ভণ্ডুল করেছে। আমি ভোট-বিশেষজ্ঞ নই, তাই এই হিসেবে গরমিল হতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে সংশয় নেই যে, শাসক দলের প্রত্যাশিত ফলাফল জুটবে না। এই হতাশা থেকেই উদ্ভূত হয়েছে নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাস।

তিন, এই সন্ত্রাসে কুলোর বাতাস দিয়েছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হুমকি। তিনি নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী ও সংবিধানে দায়বদ্ধ রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছেন। তাঁর হুমকিগুলি প্রণিধানযোগ্য। হুমকি এক: ‘দিল্লির দালাল পুলিশ এখানকার কিছু পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছে, সব কিছুর উত্তর আমি বুঝে নেব।’ লক্ষণীয়, চাকরির শর্ত ও সংবিধান মেনে রাজ্য পুলিশের যাঁরা কাজ করেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর জবানে তাঁরা ‘ভিতু’ পুলিশ, আর সংবিধানকেই থোড়াই কেয়ার করে যারা নেত্রীর মর্জি মতো চলেছে, তারা ‘সাহসী’ পুলিশ! এই সব ‘সাহসী’ পুলিশের কল্যাণে পুরসভা বা লোকসভায় কেমন নির্বাচন হয়েছে, রাজ্যবাসী তা দেখেছেন। হুমকি দুই: ‘যারা তাণ্ডব করছে, তাদের রেকর্ড আমার কাছে আছে। আমি যদি বেঁচে থাকি, প্রত্যেকটার উত্তর দিয়ে দেব। আগামী দিনে তাদের ভুগতে হবে।’ হুমকি তিন: ‘পনেরো দিনের জন্য দায়িত্ব পেয়ে কেউ যদি ভাবে মাথায় স্বর্ণমুকুট পরিয়ে দেবে, তা হলে সেটা ভুল।’ কলকাতার পুলিশ কমিশনার সৌমেন মিত্র ও বিধাননগর কমিশনার জাভেদ শামিমের সম্পর্কে এই বক্তব্য নিয়ে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু এর থেকেও কদর্য হুমকিতে মমতাদেবী কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট লুঠ করার তত্ত্ব হাজির করেছেন।

মমতাদেবীর এত মরিয়া হওয়ার কারণ একটাই। তিনি ভাল করেই জানেন যে, ১৯ মে’র নির্বাচনী রায়ে তিনি ক্ষমতা হারালে সব হারাবেন। তৃণমূল কংগ্রেস কোনও আদর্শভিত্তিক দল নয়। ক্ষমতা হারালে পরের দিন থেকেই দলে ভাঙন অনিবার্য হবে, সারদা-নারদ-উড়ালপুল বিধ্বস্ত তৃণমূল কংগ্রেসকে ধরে রাখা যাবে না। মমতাদেবীকে ‘পুনর্মূষিক’ হতে হবে। তাই তিনি এখন এই সব ভয়ংকর হুমকি দিচ্ছেন।

এই হুমকিগুলি যে সরাসরি নির্বাচনবিধি লঙ্ঘন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা হল যে, মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন কমিশনকে, দেশের সংবিধানকে থোড়াই কেয়ার করেন। তিনি আইনের শাসনের তোয়াক্কা করেন না, তাঁর কাছে মর্জির শাসনই বৈধ শাসন। এর ফলে প্রবল আশংকা আছে যে, রাজ্যে নৈরাজ্য ও মাৎস্যন্যায় কায়েম হবে, রাজ্যবাসী চরম নিরাপত্তাহীনতায় পড়বেন। এর প্রতিরোধে বিরোধীরা পথে নামলে রাজ্যে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি নেমে আসবে।

নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী সাহেব নীতিনিষ্ঠ, কঠোর মানসিকতার মানুষ। তিনি ঘোষণা করেছেন যে, কোনও মহল থেকে কোনও বেচাল দেখলে তিনি কড়া পদক্ষেপ নেবেন। সন্দেহ নেই, মমতাদেবী সেই চ্যালেঞ্জ রেখেছেন। রাজ্য প্রশাসনের প্রধান স্বয়ং যদি আইন ভেঙে সংবিধান-অতিরিক্ত কর্তৃত্ব হিসেবে নিজেকে জাহির করেন, তবে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার ও রাজ্যবাসীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব অন্তত ১৯ মে পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, একদা বাম নেতারা মমতাদেবীর এই চ্যালেঞ্জের সামনে গুটিয়ে গিয়েছিলেন। জৈদী এই চ্যালেঞ্জ নিতে সাহস করবেন কি না, বা এখন রাজ্য-রাজনীতির প্রাঙ্গণে লাখ টাকার প্রশ্ন— যে প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজ্যের, রাজ্যবাসীর নিয়তি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE