Advertisement
১৬ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

আঁধারে আলো

অনাত্মীয় কর্মীদের কর্তা ব্যবসায়ী বুঝাইতেছেন, নীরব নিস্তরঙ্গ দিন আনি দিন খাই পথেই সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল, তাই সংঘাত ছাড়িয়া কাজে মন দেওয়াই শ্রেয়। মৌলবীরাও রাস্তায় নামিয়া ধর্মের নামে অনুরোধ জানাইয়াছেন: আত্মসংবরণ করুন।

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৭ ০০:২৭
Share: Save:

হি‌ংসায় কাহারও লাভ হয় না, হিংসা বারংবার সেই শিক্ষা দিয়াছে।— বাক্যটি সম্প্রতি শোনা গেল বসিরহাট অঞ্চলের অতি সাধারণ ঘরের নাগরিকদের কণ্ঠে। প্রকাণ্ড সত্য কী ভাবে স্বাভাবিক জীবনবোধে সহজে প্রবিষ্ট হয়, এই বারের দুর্যোগক্লিষ্ট পশ্চিমবঙ্গ তাহাও দেখাইয়া দিল। বিক্ষিপ্ত একটি-দুটি দৃষ্টান্ত নহে, বহু ছোট বড় ঘটনার মধ্য দিয়া প্রকাশ যে, বাঙালি সমাজের একাংশ যদি দুরাচারের বিকট উল্লাসে মাতিয়া উঠিয়া থাকে, অন্য আর একাংশ কিন্তু তাহাকে ঠেকাইবার জন্য মরিয়া চেষ্টায় নামিয়াছে। অবরোধ বা তাণ্ডবের মাঝখানে গিয়া পড়িয়া দুর্বৃত্তবাহিনীকে ঠেকাইতেছেন সাধারণ নিরস্ত্র মানুষ। ভিন্ সম্প্রদায়ের বিপন্ন মানুষকে ছোট ছোট পরিবারগুলি আশ্রয়, আহার, আশ্বাস দিয়া সামলাইতেেছন। অনাত্মীয় কর্মীদের কর্তা ব্যবসায়ী বুঝাইতেছেন, নীরব নিস্তরঙ্গ দিন আনি দিন খাই পথেই সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল, তাই সংঘাত ছাড়িয়া কাজে মন দেওয়াই শ্রেয়। মৌলবীরাও রাস্তায় নামিয়া ধর্মের নামে অনুরোধ জানাইয়াছেন: আত্মসংবরণ করুন। যে অষ্টাদশবর্ষীয় কিশোরের ফেসবুক পোস্ট হইতে এত বড় ঘটনার সূত্রপাত, তাহার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ হইলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে গ্রামের বাসিন্দারা আন্তরিক ভাবে শোকাকুল হইয়া পড়িয়াছেন, তাঁহারা তো এত কাল নিজেদের গ্রামে এমন কাণ্ড দেখেন নাই! অঙ্গীকার করিয়াছেন, যে করিয়াই হউক, এই আগুন নিবাইতে হইবে, পুরাতন জীবনের মিলনমিশ্রণ ফিরাইতে হইবে। কেবল অকুস্থলে নহে, দূরস্থিত আধুনিক নাগরিক সমাজও নড়িয়া চড়িয়া বসিয়াছে: সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার অনেক হইয়াছে, এই বার দেখাইতে হইবে ফেসবুক ইত্যাদির সুব্যবহারের সুযোগও কতখানি। উসকানি বন্ধ করিতে হইবে। প্রতিবাদের সঙ্গে প্রতিরোধের দেওয়ালও গড়িতে হইবে। বহু কণ্ঠে শোনা যাইতেছে শুভবোধের এই আহ্বান।

কম কথা নয়। উত্তরপ্রদেশ হইতে পশ্চিমবঙ্গ সম্ভবত এইখানেই পৃথক। এখনও এ রাজ্যে বোধের দীপশিখাটি নিভে নাই। ধর্মের নামে নৃশংসতায় মাতিলে যে শেষে হাতে থাকিবে কেবল ধ্বংসের শূন্যতা, সেই শিক্ষা ভারতের অন্যত্র কতটা ছড়াইয়াছে জানা নাই, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সমাজ তাহা কিছুটা হইলেও শিখিয়াছে। ইহা আকস্মিক বা অপ্রত্যাশিত নয়। বাংলার ইতিহাসই বাঙালির এই বোধ তৈরির কৃতিত্ব দাবি করিতে পারে। সেই ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক অশান্তির বীভৎসতাও যেমন আছে, তেমনই সেই বীভৎসতা থামাইবার প্রকরণের দৃষ্টান্তও আছে। এক অঞ্চলে খুনোখুনি দেখিয়াও অন্য অঞ্চলে শান্তি রক্ষার দিবারাত্রি প্রয়াসের স্মৃতি আছে। সম্প্রীতি বস্তুটি মুখের কথা নহে, ইহা এক ধরনের বাস্তব, যে বাস্তবে বাঁচিবার অভিজ্ঞতা কাহারও থাকিলে সে বুঝিতে পারে, ইহার দাম কতখানি। শান্তি ও সম্প্রীতির সেই দামটি এই রাজ্যে গণমানসের মধ্যে নানা ভাবে বিধৃত। আগুন জ্বালাইলেই তাই এ রাজ্যে সব ঘরে আগুন ধরিয়া যায় না। অনেক ঘর সেই আগুন নিবাইয়া দিতেও জানে।

ঘনায়মান অন্ধকারে আপাতত এই আলোকরেখাটুকুই সম্বল। রাজনৈতিক শক্তিরা চেষ্টা করিবে, নিজেদের সংকীর্ণ ভোটগন্ধী প্রচারের এক ঝটকায় আলোটি নিবাইয়া দিবার। আঁচলের আড়াল দিয়া সেই ঝটকা হইতে আলোটিকে বাঁচাইতে হইবে। শান্তির আঁচলটির পরিসর ও প্রসার বহু গুণ বাড়াইতে হইবে। ইহাই এখন বাঙালি সমাজের কাজ। ধর্মভেদ স্বার্থভেদ যতই থাকুক, মানবিকতার মূল মন্ত্র ভুলিতে দেওয়া যাইবে না। বাকি সব তর্ক-বিতর্ক-মতান্তর পরে, আগে সুস্থ জীবন নামিয়া আসুক শহরে গ্রামে কেন্দ্রে সীমান্তে সকলের জন্য। বড় পরীক্ষা। কিন্তু এই মহাপরীক্ষায় বাঙালি পাশ না করিলে আর কে-ই বা করিবে। গোটা ভারতের শুভবোধ তাকাইয়া আছে পশ্চিমবঙ্গের দিকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE