মারমুখী: নলহাটি ১২ নম্বর ওয়ার্ডে বুথের দরজা বন্ধ করে ছাপ্পা ভোট চলাকালীন চিত্র সাংবাদিক ছবি তুলতে এলে তাঁর দিকে তেড়ে আসে বাহিনীর লোকজন। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।
লুইস ক্যারলের কাহিনিতে বালিকা অ্যালিস আয়নার উলটা দিকের জগতে ঢুকিয়া পড়িয়াছিল। সেখানে ডান দিক হইয়া ওঠে বাম দিক, বাস্তব হয় স্বপ্ন, অতীত হয় ভবিষ্যৎ। নির্বাচনের দিনগুলিতে এ রাজ্যও এমনই উলটা দেশে প্রবেশ করে। তখন হিংসা হইয়া যায় শান্তি, ছাপ্পা ভোট হয় অবাধ মতদান, বিপন্নতাকে নিরাপত্তা মনে হইতে থাকে। বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের অনুচরদের বিরুদ্ধে হাতে রাখি বাঁধিয়া বুথে বুথে তাণ্ডব করিবার অভিযোগ উঠিয়াছে, ইহাতে আশ্চর্যের কিছু নাই। ‘রক্ষাবন্ধন’, অর্থাৎ রক্ষা করিবার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হইবার প্রথা হইতেই নাকি রাখি বাঁধিবার রীতি আসিয়াছে। যে রাখি-পরিহিত হাতগুলি পোলিং অফিসারের হাত হইতে ইভিএম কাড়িয়াছে বলিয়া অভিযোগ, নির্বাচনী উলটপুরাণে তাহারাই গণতন্ত্রের রক্ষক। যে মহিলারা প্রাণভয়ে নলহাটির বুথ হইতে পালাইয়াছেন, যাঁহারা দুর্গাপুরে ভোট দিতে পারেন নাই, বঙ্গের ভোটরঙ্গে তাঁহারা ‘সাজানো ঘটনা।’ বুথ জ্যাম, ছাপ্পা ভোট, ভীতিপ্রদর্শন, সকলই অপপ্রচার। এমন সব অসত্যের সাক্ষ্য দেয় সাংবাদিকের ক্যামেরা, অতএব তাহা চুরমার করাই গণতান্ত্রিক কর্তব্য। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিকল্পিত ‘বিশ্ববঙ্গ’ প্রতীকের ‘ব’ অক্ষরটি তৃণমূল কর্মীদের নীল রাখির কেন্দ্রে ছিল। ইহা হয়তো বা একটি মোক্ষম ইশারা— দলের দুর্বৃত্তদের হাতে প্রশাসনের সমর্থন রহিয়াছে। অগত্যা বুথে যাহাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, তাহাদেরই প্রবেশে অগ্রাধিকার দিতে হইল পুলিশকে।
দুইটি ছবি। একটিতে নলহাটির এক বুথে তাণ্ডব নিরীক্ষণরত প্রশাসনিক কর্তা ও পুলিশ কর্মীদের উদ্বিগ্ন মুখের সারি। অপরটিতে অনুব্রত মণ্ডলের সহাস্য মুখমণ্ডল। পাঠ্যবইয়ের গণতন্ত্র অনুসারে উল্লাস ও উদ্বেগের স্থান বিপরীত হইবার কথা ছিল। পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্রের উলটপুরাণে নেতা নিঃশঙ্ক, শঙ্কিত পুলিশ। দুর্গাপুরে বিরোধীরাও গণতন্ত্রের ‘সুরক্ষা’য় হাত লাগাইয়াছেন, তাই নির্বাচনের দিনটি আরও ঘটনাবহুল হইয়া উঠিয়াছে। ভোটারদের কষ্ট করিয়া বুথ পর্যন্ত যাইতে হয় নাই, শাসক অথবা বিরোধী দলের কর্মীরা পূর্বেই বাড়ির পথ ধরাইয়া দিয়াছে। পোলিং এজেন্টরা সারাদিন বুথে বসিবার দায় হইতে নিষ্কৃতি পাইয়াছেন পূর্বাহ্ণেই। শান্তি বিঘ্নিত করিবার অপরাধে সাংবাদিক ও পুলিশকে যাহারা শিক্ষা দিয়াছে, স্থানীয় নাগরিকের চোখে তাহারা বহিরাগত, নেতাদের মতে তাহারা ‘এলাকার মানুষ’। বোমা ফাটিয়াছে, গুলি ছুটিয়াছে, পুলিশের রাইফেল ও ইভিএম যন্ত্র ছিনতাই হইয়াছে। কিন্তু দিনের শেষে রাজ্য নির্বাচনী অফিসার দাবি করিয়াছেন, ভোট হইয়াছে শান্তিপূর্ণ।
ইহা নূতন নহে। বামফ্রন্ট আমল হইতে এই উলটপুরাণের অভিনয় ঘটিয়া আসিতেছে। প্রতিটি নির্বাচনের দিন আতঙ্ক, বিরক্তি লইয়া উদয় হয়। রাজ্যের সকল ভোটদাতা নির্বিঘ্নে বুথে গিয়া ভোট দিয়া আসিবেন, এ রাজ্যে তাহা প্রায় অকল্পনীয়। সাংবাদিকেরা মার খাইয়া, ভাঙা ক্যামেরা, দগ্ধ মোটরবাইক লইয়া ফেরেন নাই, এমন নির্বাচনও এ রাজ্য দেখে নাই। উলটা নিয়মে দর্শক সাজিয়া নেতা ও তাহাদের অনুচরদের তাণ্ডব দেখিয়া যাইতেছে পুলিশ। গণতন্ত্র যাঁহাকে দিয়াছে রাজার পার্ট, সেই নাগরিকের জন্য পড়িয়া আছে শুধু কাটা সৈনিকের ভূমিকা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy