অর্থনীতিতে মন্দার ছায়া। গ্রামীণ অর্থনীতিতেও তার প্রভাব পড়েছে। ছোট ছোট বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পাথর শিল্পাঞ্চলেও পড়েছে তার ছায়া। যে কোনও সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে ক্রাশার। মাথার উপর ঝুলছে ছাঁটাইয়ের খাঁড়া। তাই ধুমধাম করে বিশ্বকর্মা পুজো এখন অতীত। বাঙালির জীবনে শিল্পকর্মের সৃষ্টিকর্তা বিশ্বকর্মার আসন বিভিন্ন জায়গায় পাতা হলেও তা আগের জৌলুস হারিয়েছে। জেলার পাথর শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে কর্মকার, স্বর্ণকার, কাঠ মিস্ত্রি, সাইকেল মিস্ত্রি থেকে গাড়ি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সকলেই পুজো সারছেন। কিন্তু, সে পুজোর কার্যত জৌলুসহীন। প্রতিযোগিতা মূলক বাজারে গ্রামীণ কুটির শিল্পগুলিকে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে। সোনার আকাশছোঁয়া দরের জন্য স্বর্ণকারদের অধিকাংশই কেবল মাত্র দোকান খুলে রেখেছেন, কাজ নেই। তাই বার্ষিক পরব হিসেবে বিশ্বকর্মা পুজোর আনন্দও যেন ফিকে। কোথায় যেন তাল কেটে গিয়েছে। অর্থনীতির বেহাল দশায় তাই উৎসবেও ভাটা।
গ্রামের কথাই ধরা যাক। সেই গ্রামের পথের ধার। যেখানে মাটির তৈরি খড়ের চালা ঘরের নীচে এক পাশে কয়লার উনুন জ্বলছে। সেখানে এক হাতে হাপর টান দিয়ে উনুনে হাওয়া দিচ্ছে শিল্পী। অন্য হাতে হাতুড়ি দিয়ে লোহাতে ঘা দিয়ে চলছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত গ্রামের কামার শালাগুলোয় লোহাতে ঘা দেওয়ার শব্দ আর তেমন শোনা যায় না। কোথাও কোথাও শুনতে পাওয়া গেলেও আধুনিক সভ্যতায় গ্রামীণ সেই কুটির শিল্প আর বেঁচে নেই বললেই চলে। কিংবা ছুতোর বাড়ির কাঠের ঠুকঠাক শব্দ এখন আর তেমন শুনতে পাওয়া যায় না। গ্রামের এই কুটির শিল্পের চাহিদা না থাকার জন্য গ্রামীণ অর্থনীতিতে যেন ছন্দপতন ঘটেছে। গ্রামের পথে কামার শালায় লাঙলের ফলা তৈরি যেমন উঠে গিয়েছে তেমনি গ্রামের কাঠ মিস্ত্রির বাড়িতে লাঙল তৈরি হয় না। নলহাটি থানার বুজুঙ গ্রামের বাসিন্দা ডালিম পাল, সুলতানপুরের বাসিন্দা অসীম সেনরা জানালেন, ভাদ্র মাসে ভরা নদী, পুকুর খাল বিল জলে টইটম্বুর, ধানের খেতে যখন শিশিরের রেখা পড়ে, যখন কাশের বনে হাওয়া দোলা দেয় তখনই বিশ্বকর্মা পুজো যেন বার্ষিক একটা উৎসবের আকারে আসে। কামারশালা, ছুতোরের দোকানে, গ্রামের ছোট ছোট সাইকেল গ্যারাজ, রেডিও টিভি মেরামতির দোকানগুলোতে বছর পাঁচেক আগেও বিশ্বকর্মা পুজো ঘিরে একটা আলাদা উন্মাদনা চোখে পড়ত। কারণ বিশ্বকর্মা পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ল মানে শারদ উৎসবের শুরু হল বলে মনে করেন অনেকেই। কিন্তু ক্রমেই হারিয়ে গিয়েছে কামারশালা, কাঠ মিস্ত্রির কাজ। চাহিদা না থাকার জন্য বর্তমান প্রজন্মও তাঁদের পিতৃপুরুষের ব্যবসায় থাকতে চায় না। যার জন্য গ্রামের দিকে বিশ্বকর্মা পুজোর জাঁক কমে গিয়েছে।
গ্রামের পথে এখন রিকশাও তেমন দেখা যায় না। ফলে গ্রামের রিকশাচালকেরা আর বিশ্বকর্মা পুজো করেন না। গ্রামের পথে টোটো, অটো, ট্রেকার চলছে। বিশ্বকর্মা পুজোও এখন মূলত টোটো, অটো, ট্রেকার চালকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। টোটো-অটোচালকদের জাঁকজমকপূর্ণ বিশ্বকর্মা পুজোয় কোথাও যেন আসল ছবিটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
একটি ক্রাশারে সকালে ছোট করে বিশ্বকর্মা পুজো। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম
কোথাও কোথাও গ্রামে লোহার গ্রিল তৈরির কারখানা, রাজমিস্ত্রির বাড়িতে, কিংবা গ্রামের দিকেও কেবিল অপারেটরের দোকানে বিশ্বকর্মা পুজো হতে দেখা গিয়েছে। আবার গ্রামের ধানভাঙা মিল, সর্ষে তেল তৈরির মিল বা মুড়ি মিল, কয়লার গুঁড়ো থেকে তৈরি গুলের কারখানায় বিশ্বকর্মা পুজো হতে দেখা গিয়েছে এ বছরও। কিন্তু সবেতেই যেন গা-ছাড়া ভাব।
তবে, অনাড়ম্বর এবং উৎসাহে ভাটার ছবি সবচেয়ে স্পষ্ট জেলার পাথর শিল্পাঞ্চলগুলিতে। মুরারই থানার রাজগ্রাম, নলহাটি থানার বাহাদুরপুর, রামপুরহাট থানার বড়পাহাড়ি, বারমেসিয়া, তেঁতুল বাধি, দিঘলপাহাড়ি, শালবাদরা, মহম্মদবাজার থানার পাঁচামি সমস্ত জায়গাতেই নমো নমো করে বিশ্বকর্মা পুজো সারতে
হয়েছে বলে জানিয়েছেন খাদান ও ক্রাশার মালিকেরা। শালবাদরা পাথর শিল্পাঞ্চলের মালিক সমিতির সদস্য সন্তোষ গুপ্ত, মইনউদ্দিন হোসেনরা বললেন, ‘‘দু’বছর আগে পর্যন্ত জেলার পাথর শিল্পাঞ্চলগুলিতে বিশ্বকর্মা পুজো ঘিরে কত উৎসাহ ছিল। সবাই সকাল সকাল স্নান করে ক্রাশারে চলে আসতেন। পুজো শুরু হত। এ কারখানা, ও কারখানা থেকে লোকজন আসত। রাতে খাওয়া–দাওয়া সেরে বাড়ি ফিরতেন। নাচ-গানের আসরও বসত। মালিকদের মধ্যেও বিশ্বকর্মার পুজোর দিন ভাব বিনিময় হত। এখন কোথায় কী!’’ তাঁদের দাবি, এ বার বিশ্বকর্মা পুজোর দিন মালিকেরা সকালে ছোটখাট ভাবেই পুজো হয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য প্রাচীন রীতি মেনে শ্রমিকদের জন্য একটি দিন খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
বিশ্বকর্মা পুজোয় মন ভাল নেই ভারী গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকানদার এবং গ্যারাজ মিস্ত্রিদেরও। নিত্যনতুন আধুনিক মডেলের গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রি হওয়ার ফলে অধিকাংশ পুরনো দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। গাড়ি ব্যবসায় সার্বিক মন্দার সরাসরি প্রভাব পড়েছে বিশ্বকর্মা পুজোয়। বিশেষ করে গাড়ির শো-রুমগুলিতে পুজোর বাজেট অনেকটাই কাটছাঁট করা হয়েছে। রামপুরহাট শহরে ২৪ বছর ধরে ভারী গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রি করছেন সুখেন পাল নামে এক ব্যবসায়ী। তিনি জানালেন, আগে রামপুরহাট বাসস্ট্যান্ডে ৮টি যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকান ছিল। এখন দু’টোয় এসে ঠেকেছে। রামপুরহাট নিশ্চিন্তিপুরে ৭টি দোকান ছিল। বর্তমানে একটি কোনও ক্রমে টিকে আছে। সুখেনবাবুর কথায়, ‘‘বছর কয়েক আগেও দোকানে দোকানে ধুমধাম করে বিশ্বকর্মার পুজো হত। কর্মচারীদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা থাকত। এখন তো ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই বিরাট চ্যালেঞ্জ! ফলে বিশ্বকর্মা পুজোয় আড়মব্র করব কী ভাবে?’’
পুজো ঘিরে উৎসাহ হারিয়েছেন রামপুরহাট শহরের সোনার ব্যবসায়ীরাও। তাঁদের অনেকেই দোকান চালু রেখে সকাল সকাল তুলাযন্ত্রের পুজো করেছেন। টানা অচলাবস্থার মুখে জাতীয় টেলিকম সংস্থা বিএসএনএল। মাস ছয়েক বেতন পাননি অস্থায়ী কর্মীরা, স্থায়ী কর্মীরাও অগস্টের বেতন হাতে পাননি। পুজোর মুখে বেতন পেতে পেতে অক্টোবর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। তাঁদের অনেকেরই আশঙ্কা, এই বিশ্বকর্মা পুজোই শেষ পুজো! অতএব স্রেফ পুজোর জন্য পুজো করা। তাতে নেই আনন্দের ছোঁয়া। অনাড়ম্বড়েই বিশ্বকর্মার আসন পাতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy