Advertisement
১৮ মে ২০২৪
Walls

প্রাচীর সভ্যতা

সম্পর্কের মধ্যে প্রাচীর তুলিবারও বন্দোবস্ত ছিল। প্রিয় দুই মানুষের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ করিতে ইহার জুড়ি নাই।

—ফাইল চিত্র

—ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২১ ০১:৩৩
Share: Save:

বোঝা যাইতেছে, প্রাচীর অতি বিষম বস্তু। তাহার উপযোগিতা যেমন, অপকারিতারও শেষ নাই। কৌতুক করিয়া কেহ বলিতে পারেন আহা, একদা কলিকাতার গলিতে গলিতে পাঁচিলের কত মহিমা ছিল। সেখানে ভিজে জামাকাপড় শুকাইতে দেওয়া চলিত, রাজনীতির স্লোগান খোদাই করা যাইত। অতীতে উনুন-মুখর কলিকাতায় পাঁচিলের গায়ে ঘুঁটে দেওয়ার দস্তুর ছিল। শীতে পাঁচিলের মাথায় বসিয়া পা দুলাইতে দুলাইতে পাড়া ক্রিকেট দেখা যে কী আমোদের বিষয় ছিল, যিনি দুলাইয়াছেন তিনিই জানেন। পাঁচিলের মাথায় রোদ অনেক ক্ষণ থাকিত বলিয়া পাড়ার মাসি-পিসি-ঠাকুমারা পাঁচিল-শীর্ষে শিশিভর্তি আচারের রস শুকাইতে দিতেন। পাঁচিল এই সকল ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক। একার সম্পত্তি নয়, সকলের সম্পত্তি। দুই বাড়ির মাঝের পাঁচিলের একটি অংশ তাই আদর করিয়া পথচারীগণ ভাঙিয়া দিতেন। সেই ফাঁকই তাঁহাদের চলাচলের সহজ রাস্তা। সুতরাং, পাঁচিল তুলিয়া দিলেও সেটিকে সামাজিক ভাবে কাজে লাগাইয়া দিব্য কৌমসুখ উপভোগ করা চলে। তবে সে সব আজ লঘু কথা বলিয়ে ঠেকে।

সম্পর্কের মধ্যে প্রাচীর তুলিবারও বন্দোবস্ত ছিল। প্রিয় দুই মানুষের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ করিতে ইহার জুড়ি নাই। শরৎচন্দ্রের ‘রামের সুমতি’-তে যে সম্পর্ক ছিল স্নেহের, তাহার মাঝে বিষম প্রাচীর উঠিল। আত্মীয়তা আর প্রণয়ের মধ্যেই কেবল দেওয়াল উঠিয়া যায় না, সমাজের মধ্যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দেওয়ালের উপস্থিতিও ছিল। রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন পাঁচিল ভাঙিবার নাটক। দীর্ঘ দিন ধরিয়া এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকৃত গুরুর অনুপস্থিতিতে ক্লান্তিকর নিয়মের প্রাচীর প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। প্রতি পদে নিয়ম, ইহা নিষেধ, উহা নিষেধ। এই দিকের জানালা খুলিলে বিপত্তি, ওই দিকের পাড়ায় যাইলে অসন্তোষ; প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। শেষ অবধি গুরু আসিলেন, পাঁচিল পড়িল ভাঙা। কিন্তু প্রশ্ন হইল, অচলায়তন কি কেবল পাঁচিল ভাঙিবার নাটক? নিয়ম অতিক্রম করিবার সাহিত্য? নহে, নহে। যাহারা পাঁচিল ভাঙিয়াছিল সেই নাটকে, গুরু তাহাদের ফের পাঁচিল তুলিবার কাজে লাগাইয়া দিলেন। আসলে রবীন্দ্রনাথ কেবল নিয়ম ভাঙিবার কথাই বলিতেন না, নিয়ম গড়িবার কথাও বলিতেন। তবে সেই নিয়ম উপর হইতে চাপাইয়া দেওয়া চলিবে না, সেই নিয়ম ভিতর হইতে জাগাইয়া তুলিতে হইবে। যে নিয়ম যান্ত্রিক ভাবে উপর হইতে চাপাইয়া দেওয়া হয়, সেই নিয়মের প্রাচীর ভাঙাই মানবিকতা, আর যে নিয়ম ভিতর হইতে জাগিয়া উঠে, সেই নিয়মের ভিত্তি স্থাপন করাই সংস্কৃতি। রবীন্দ্রনাথ মনে করিতেন, এই ভিতর হইতে জাগিয়া উঠা নিয়মের সংগঠন যে জাতি করিতে পারে, সে জাতিই অগ্রসর হয়। শান্তিনিকেতনে যে সহজ জীবনযাত্রা একদা অনুসৃত হইত, ভিতরের নিয়মের ভিত্তির উপরেই তাহা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। সেই নিয়মের ভিত্তি আদর্শের জন্ম দিয়াছিল। সেই আদর্শ কেহ না বুঝিয়া অনুসরণ করিতেন না, সেই আদর্শ পালনের নীরব নিষ্ঠায় তাঁহারা আত্মনিয়োগ করিতেন।

প্রশ্ন হইল, এক্ষণে বাঙালি কী করিতেছে, তাহা হয়তো নিজেই ভাল করিয়া বুঝিতে পারিতেছে না। দিশাহারা দশা। এক দিকে ভাবিতেছে, কোনও নিয়মই তাহারা মানিবে না। যাহা ইচ্ছা তাহাই করিবে। নিয়মের সৌষ্ঠব ভাঙিয়া ফেলিবে। ইহারই বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া হিসাবে আর এক দল শুদ্ধিকরণের ধুয়া তুলিয়াছেন। নিজেদের উপর বিশ্বাস নাই বলিয়া তাঁহারা ভাবিতেছেন, কেহ তাঁহাদের বিধিবদ্ধ নিয়মের দাসানুদাস করিয়া দিলে বুঝি বেশ হইবে। সেই বিধির সংস্কৃতি মানিতে হিন্দুত্ববাদের আশ্রয় লইতেছেন। বাঙালিদের প্রিয় দেবতারা তো রহিয়াছেন, পাশাপাশি নব নব দেবতার আবির্ভাব ঘটিতেছে। সেই সকল দেবতার পূজার কী সমারোহ, সম্পদের কী দেখনদারি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও কেহ কেহ পাঁচিল বানাইতে ব্যস্ত হইয়াছেন। এই দুই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই ক্ষতিকর। যথা ইচ্ছা নিয়মের পাঁচিল ভাঙিলে বা ঐশ্বর্যময় কারুকার্যখচিত পাঁচিলের শরণ লইলে, শেষ অবধি পথ তোরণদ্বারে মুক্ত না-ই হইতে পারে। কানাগলি বড় ভয়ঙ্কর। আশায় আশায় পথ চলা, শেষ অবধি বুঝি গলিটি কোনও বড় রাস্তায় উন্মুক্ত হইবে! কিন্তু পরিশেষে দেখা যাইল, গলি রাজপথে পড়িল না, পাঁচিলে আটকাইয়া গেল। বাঙালির ভাবিয়া দেখা উচিত, পথ যাহাই হউক, পথের শেষে উন্মুক্তির কথা ভাবা চাই। পাঁচিল ভাঙা বা গড়া পন্থা মাত্র, যে কোনও পন্থার পরিণতিই কিন্তু তাহার সার্থকতার মাপকাঠি। পাঁচিলে মুক্তি মিলিবে তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Walls Socialization
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE