পরবর্তী মহাযুদ্ধের বিষয় হইবে জল, এমন একটি কথা এক সময় খুবই প্রচলিত হইয়াছিল। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও জল ভারতীয় নির্বাচনের বিষয় হইয়া উঠিতে পারিল না! অথচ, সম্প্রতি একটি অসরকারি সংস্থার সমীক্ষায় প্রকাশিত সংবাদ: এই মুহূর্তে ভোটদাতার দৃষ্টিতে শহরে পানীয় জল, এবং গ্রামে সেচের জল হইল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলির একটি। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে বেকারত্ব এবং ফসলের ন্যায্য মূল্যের দাবির প্রায় সমান গুরুত্ব পাইয়াছে সেচের জল। আশ্চর্য হইবার উপায় নাই। ভারতের আটটি রাজ্য ইতিমধ্যেই খরা ঘোষণা করিয়া কেন্দ্রের নিকট সহায়তা প্রার্থনা করিয়াছে। আরও দুইটি রাজ্য, উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশ, খরাগ্রস্ত হইয়াছে— কিন্তু পরিকাঠামো এবং উদ্যোগের অভাবে খরা ঘোষণার শর্তগুলি পূরণ করা হয় নাই। ইহার প্রধান কারণ, ভারতে কৃষি আজও বৃষ্টিনির্ভর, মাত্র পঁয়ত্রিশ শতাংশ জমি যথার্থ সেচের সুবিধা পাইয়া থাকে। গত বৎসর খরিফ মরসুমে বৃষ্টি কম হইয়াছে, দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে শীতের মরসুমে মোটে বৃষ্টি হয় নাই। ফলে মোট কৃষিজমির বিয়াল্লিশ শতাংশ খরাকবলিত, লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ মানুষের জীবিকা সঙ্কটাপন্ন। আক্ষেপ, এত বড় সঙ্কটকে ঢাকিয়া দিয়াছে নির্বাচনী যুদ্ধের কলরব। দেশবাসী প্রশ্ন করিতে ভুলিয়াছেন, এই দুঃসময়ে তাঁহাদের কী সহায়তা মিলিল? যে রাজ্যগুলি খরা ঘোষণা করিয়াছে, (কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান ও তামিলনাড়ু) তাহারা চাষিদের সহায়তায় চাহিয়াছিল বাইশ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্র মঞ্জুর করিয়াছে আট হাজার কোটি, তাহার অর্ধেকেরও বেশি পাইবে মহারাষ্ট্র। সে রাজ্যে খরার তীব্রতা ২০১৬ সালের পরিস্থিতির চাইতেও ভয়ানক হইয়া উঠিয়াছে। সেচ দূরস্থান, পানীয় জলের সঙ্কট এমন পর্যায়ে পৌঁছাইয়াছে যে পানীয় জলের গাড়ির দেখা মিলিলে নিমেষে নির্বাচনী সভা শূন্য হইয়া যাইতেছে।
উল্লেখযোগ্য, মহারাষ্ট্রের সাড়ে তিন শত ব্লকের প্রায় অর্ধেক খরাগ্রস্ত, তৎসত্ত্বেও মহারাষ্ট্রের সাধারণ নির্বাচনে খরা বা সেচ একটি প্রধান প্রশ্ন হইয়া ওঠে নাই। পুলওয়ামাতে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ, ও তাহার জেরে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই সেখানকার প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হইয়া উঠিয়াছে। বিরোধী দলগুলি সেচ ও কৃষির সঙ্কটকে ‘বিষয়’ করিয়া তুলিতে পারে নাই। সরকারকে দায়িত্ব পালন না করিবার জবাবদিহি করিতে হয় নাই। যে গ্রামে ফসল জ্বলিয়া গিয়াছে, পানীয় জলের উৎস শুকাইয়াছে, তাহার বাসিন্দারাও প্রতিবেশী দেশকে ‘শিক্ষা’ দিতে পারিবার উল্লাসে ভোট দিতে যাইবেন। গণতন্ত্রের কী বিচিত্র পরিহাস! ভরসা এই যে, নাগরিক জীবিকার গুরুত্ব ভোলেন নাই। গ্রামীণ এলাকার চল্লিশ শতাংশ নাগরিক বলিয়াছেন, নির্বাচনের বিষয়রূপে সেচ তাঁহাদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ। তাহার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকও আছেন, সেচের উন্নয়নের প্রশ্নে সরকারকে অতিশয় কম নম্বর দিয়াছেন।
আশ্চর্য নহে। দক্ষিণবঙ্গে নদীর অভাব নাই, ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্পে প্রচুর পুকুর নির্মাণের দাবি করিয়া থাকে তৃণমূল সরকার। তৎসত্ত্বেও ভূগর্ভস্থ জলের উপর সেচের নির্ভরতা সর্বাধিক। ইহা পানীয় জলে আর্সেনিক প্রভৃতির দূষণ ছড়াইতেছে, কৃষিকেও বিপন্ন করিতেছে। জল, বায়ু ও মাটির মতো মৌলিক বিষয়গুলি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূলস্রোতে না আসিবার অর্থ, এগুলি রাষ্ট্রের নিকট উপেক্ষিত হইতেছে। তাহার বিপদ এখনই স্পষ্ট, কিন্তু ক্রমশ আরও তীব্র হইবে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে উষ্ণতা বাড়িবে, বর্ষা অনিশ্চিত হইবে এবং শুষ্ক দিনের সংখ্যা বাড়িবে। দেশের চুয়াল্লিশ শতাংশ মানুষের জীবিকা কৃষি, অতএব দেশের অভ্যন্তরে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হইবে, তাহা সমগ্র অর্থনীতিকেই বিপন্ন করিবে। তবু কেন নাগরিকরা এ বিষয়ে নেতাদের দৃষ্টিপাত দাবি করেন না, বোঝা অত্যন্ত কঠিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy