Advertisement
১১ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

হতভাগ্য আমরা

আমরা আমাদের ছেলেটিকে ছোটবেলা থেকে শেখাই না যে, খেলার সঙ্গিনীদের মতামতকে গুরুত্ব দাও। শেখাই না যে, বোন বা বান্ধবী যেমন ঢাকা জায়গা ছাড়া মূত্রত্যাগ করে না, তেমনই, গোটা পৃথিবীটাই তোমার টয়লেট না! এ-সব শেখাই না বলেই আমাদের ছেলেরা অশিক্ষিত থেকে যায়। সম্মতির মানে জানে না। আমাদের মেয়েগুলো আত্মহত্যা করে অথবা বেঁচে থাকে ‘কোয়েশ্চেনেবেল ক্যারেক্টর’ হয়ে। আর হতভাগ্য আমরা ঘটনার পর কপাল চাপড়াই।পিঙ্ক’ দেখলাম। সিনেমা হলে বসে আমার চোখের সামনে কলির মুখ ভাসছিল। কলিকে (নাম পরিবর্তিত) আমি চিনতাম। যে কলি সম্প্রতি আত্মহত্যা করল, যাকে নিয়ে চ্যানেলে চ্যানেলে আলোচনার আসর বসল, সেই কলির কথা বলছি।

দোলন গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

পিঙ্ক’ দেখলাম। সিনেমা হলে বসে আমার চোখের সামনে কলির মুখ ভাসছিল। কলিকে (নাম পরিবর্তিত) আমি চিনতাম। যে কলি সম্প্রতি আত্মহত্যা করল, যাকে নিয়ে চ্যানেলে চ্যানেলে আলোচনার আসর বসল, সেই কলির কথা বলছি।

কলির বাড়ি খড়িবেড়িয়ায়, কলকাতার গা-ঘেঁষা একটি গ্রামে। কলি যখন বিদ্যাপুর (নাম পরিবর্তিত) স্কুলে ক্লাস এইটের ছাত্রী, তখন আমার সঙ্গে তার আলাপ। সে প্রায় বছর পাঁচেক আগের কথা। কলিকে বিশেষ ভাবে মনে আছে, কারণ কলি ছিল তুখড় ছাত্রী, যেমন লেখাপড়ায়, তেমন নাচ গান আঁকায়। এমন বহুমুখী প্রতিভা সচরাচর চোখে পড়ে না। সংসারে কলির মা আর বোন ছিল। সংসার চলত টেনেটুনে।

কলির সঙ্গে স্কুলে পড়াকালীন সুবোধের (নাম পরিবর্তিত) প্রেম। মাধ্যমিকের পরের ছুটিতে তারা পালিয়ে বিয়ে করে। সাত-আট মাস শ্বশুরঘর করার পর সে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মায়ের কাছে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। তার পর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় আবার স্কুলে ভর্তি হয়। পড়াশোনায় মন দেয়। কিন্তু সুবোধ তার পিছু ছাড়ে না। বিরক্ত করতে থাকে। হুমকি, গালাগাল, ফোনে কুৎসিত মেসেজ কিছুই বাদ যায় না। কলিকে তার মা এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দিদিরা অনেক বলা সত্ত্বেও সে পুলিশে নালিশ করতে রাজি হয় না। সুবোধের সাহস বাড়তেই থাকে। এক দিন সে কলির সঙ্গে তার যৌনমিলনের ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করে দেয়। কলি সেই খবর পায়। ভেঙে পড়ে। নিজের কথা ভাবে, ছোট বোনের কথা ভাবে, যন্ত্রণায় ছটফট করে, তার পর আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।

কলি একা নয়। আমাদের চার পাশে বহু অল্পবয়সি মেয়েই বিপদসীমার কিনারা ধরে হাঁটছে। অনেকেই নিজের মৃত্যু পর্যন্ত বেছে নিচ্ছে। কেন? কীসের এত শরম? যদি কোনও ছেলের (কিংবা মেয়ের) সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়ই, তা হলেই বা এত লজ্জা কেন? সর্বক্ষণ নিজের শরীর ঘিরে মেয়েদের এত কুণ্ঠা, অপরাধবোধ কেন?

উত্তর খুঁজতে নিজেদের দিকে তাকানো দরকার। জন্মের পর, কাঁথা ভেজানোর কাল থেকে মেয়েদের দেহ ঘিরে নানা নিষেধাজ্ঞা। ছেলেরা যে বয়সে উলঙ্গ হয়ে নেচেকুঁদে বেড়ায়, মেয়েদের তখনই অঙ্গে তুলতে হয় হাঁটু-ঝুল পোশাক। যে সদ্য-কিশোরী গায়ে জামা রাখতে চায় না তার কপালে জোটে ধিঙ্গি, বেহায়ার তকমা। যে বয়সে হাত-পা ছড়িয়ে বেড়ে ওঠার কথা, সেই বয়সে মেয়েদের বুকের কাছে লম্বা খাতা অথবা ফাইল আঁকড়ে জবুথবু হাঁটতে শেখানো হয়। নিজের দেহ লজ্জা, ঘেন্না আর ভয়ের— এ শিক্ষা পেতে পেতেই আমাদের মেয়েরা বড় হয়।

ভয়ের? কীসের ভয়? পাছে কেউ ছুঁয়ে দেয় কিংবা মেয়েই কাউকে ছুঁয়ে ফেলে সেই ভয়! এই ছোঁয়াছুঁয়ির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে আমাদের সমস্ত যৌনতাবোধ। আর আমাদের সমাজ যৌনতার, নির্দিষ্ট ভাবে যৌন সম্পর্কের, স্বীকৃতি দেয় শুধুমাত্র নারী-পুরুষের বিবাহবন্ধনে। বিয়ের বাইরের যৌনতা নিষিদ্ধ। বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে। তাই যে মেয়ে অতীত সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে নতুন জীবনের কথা ভাবছে তাকে অতীতের যৌন অভিজ্ঞতাকেও অস্বীকার করে চলতে হয়। সেই জন্যই যখন অতীত যৌনজীবনের ছবি দুনিয়ার কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়ে, তখন কলির ভাবনায় নতুন ভবিষ্যতের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, আত্মহত্যাকে শ্রেয় বলে মনে করে কলি।

মেয়েদের যৌন শুচিতাকে প্রাধান্য দেওয়ার কুসংস্কার আমাদের সমাজে আজও প্রবল। এ যুগেও মেয়েদের যৌনতা নিয়ন্ত্রিত হয় পুরুষের যৌন তাগিদের দ্বারা। এখনও পুরুষ সঙ্গীর ইচ্ছেমত, নির্দেশ মাফিক, বিছানায় যেতে হয় বেশির ভাগ মেয়েকে। যৌন সম্পর্কে তাদের ‘না’ বা ‘হ্যাঁ’ শুনতে সমাজ আজও নারাজ। বিশেষত যে মেয়ে এক বার যৌনজীবনে সম্পৃক্ত হয়, তাকে ‘সহজলভ্যা’ মনে করে নিতেই অভ্যস্ত আমাদের ছেলেরা। তাই মিনাল বা কলি মাথা কুটে মরলেও তাদের ‘না’ গ্রাহ্য হয় না পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত সমাজে।

আসলে যৌনসম্পর্কে মেয়েদের সম্মতির ধারণাটি আমাদের সমাজে এখনও ঠিক বাসা বাঁধতে পারেনি। সারাক্ষণ আমরা মনের মধ্যে মেয়েদের দুভাগে ভাগ করি— ভাল মেয়ে আর খারাপ মেয়ে। অর্থাৎ সচ্চরিত্রা আর দুশ্চরিত্রা। এই ‘দুশ্চরিত্রা’ মেয়েরা স্বাধীনচেতা, সমাজের চোখরাঙানিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আপন খুশিতে বাঁচে। ইচ্ছেমত পোশাক পরে, রাতবিরেতে ঘুরে বেড়ায়, হা হা করে হাসে, ছেলেদের মোটে ভয় পায় না, মদ সিগারেট খায়, ইত্যাদি। আমাদের ঘরের ছেলেরা এমন মেয়েদের ‘সহজলভ্যা’ ভাবে। এবং ভয় পায়। এই একবিংশতেও আমাদের বোকা ছেলেগুলি ভাবে যে, ঘরে-বাইরে তারাই মাতব্বর, তাদের হাতেই মেয়েদের লাটাই। আর যে মেয়ে সে লাটাইয়ের সুতো ছিঁড়ে নিজের ছন্দে জীবনের আকাশে ডানা মেলে, সেই মেয়েদের দেখলেই ছেলেরা ক্ষমতা চলে-যাওয়ার ভয়ে মারমুখী হয়ে ওঠে। মেয়েদের ‘না’-কে ক্ষমতার দম্ভে পদদলিত করে। আমাদের ছেলেরা শেখেইনি যে, এ পৃথিবীটা যতটা তাদের, ততটাই মেয়েদের। মেয়েদের ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ শোনাটাই সভ্যতা— মানবাধিকারের এই প্রথম পাঠের শিক্ষা আজও তাদের হয়নি। কলি এবং মিনাল দুজনে সম্পূর্ণ আলাদা সামাজিক অবস্থানে থাকলেও দুজনেই ‘না’ বলেছিল। কিন্তু মেয়েদের ‘না’ শোনার শিক্ষা ছিল না সুবোধ অথবা রাজবীরের, তারা তাদের অশিক্ষা থেকে, পিতৃতান্ত্রিক অহংকার থেকে কলি এবং মিনালের অসম্মতিকে অগ্রাহ্য করেছিল।

সুবোধ, রাজবীর... কারা এই ছেলের দল? এরা কি মঙ্গলগ্রহ থেকে সহসা আবির্ভূত হল? না। এরা আমার আপনারই ঘরের ছেলে। এদের শিখিয়ে পড়িয়ে আমরাই বড় করছি। তার মানে আমাদের এই বড় করায় খুব বড় রকম ফাঁক থেকে যাচ্ছে। কী সেই ফাঁকগুলি? আমরা আমাদের নিকটাত্মীয় ছেলেটিকে ছোটবেলা থেকে শেখাই না যে, ছোটবোনের, খেলার সঙ্গিনীদের মতামতকে গুরুত্ব দাও। আমরা তাদের শেখাই না, বোন অথবা বান্ধবী যেমন আদুড় গায়ে ঘুরতে পারে না, ঢাকা জায়গা ছাড়া মূত্রত্যাগ করে না, তেমনই তুমিও খালি গায়ে লোকসমক্ষে বেরোতে পারো না, গোটা পৃথিবীটাই তোমার টয়লেট না! এ-সব আমরা শেখাই না বলেই আমাদের ছেলেরা আজও অশিক্ষিত থেকে যায়। আজও সম্মতির মানে জানে না। আমাদের মেয়েগুলো আত্মহত্যা করে অথবা বেঁচে থাকে ‘কোয়েশ্চেনেবেল ক্যারেক্টর’ হয়ে। মিনালের মতো। আর হতভাগ্য আমরা, অভিভাবকের দল, পিতৃতন্ত্রের এই বিষময় চক্রে আবর্তিত হই এবং ঘটনার পর কপাল চাপড়াই।

‘পিঙ্ক’-এ অমিতাভ বচ্চন উকিলের পোশাক পরে ঠিকই বলেছেন, আমাদের ছেলেগুলোকে বাঁচানো দরকার, তবেই আমাদের মেয়েগুলো বাঁচবে।

পিঙ্ক ছবির একটি দৃশ্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE