Advertisement
০১ জুন ২০২৪

বৈষম্য দূর করার উপায় কী

বীরভূম, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কলকাতা থেকে আগত শিক্ষকেরা বয়ঃসন্ধির যৌনতা এবং জেন্ডার বৈষম্য নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন একটি আলোচনা সভায়।

জিনাত রেহেনা ইসলাম
শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৭ ১৩:২১
Share: Save:

পনেরো-ষোলো বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যৌনতার প্রকাশ ঘটবে, তা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হবে, সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু তাকে কী ভাবে দেখবেন শিক্ষকেরা? বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পড়ুয়াদের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ কি ‘স্বাভাবিক’? তৃতীয় লিঙ্গের ছাত্রদের জন্য আলাদা বাথরুম কি প্রয়োজন? কৈশোরের যৌনতা থেকে যে পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে স্কুলে, তা মোকাবিলার জন্য শিক্ষকেরা বিজ্ঞানভিত্তিক ‘টিপস’ পাবেন কোথা থেকে?

বীরভূম, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কলকাতা থেকে আগত শিক্ষকেরা বয়ঃসন্ধির যৌনতা এবং জেন্ডার বৈষম্য নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন একটি আলোচনা সভায়। আচার্য যদুনাথ সরকারের স্মৃতিবিজড়িত বাসভবনে আয়োজন হয়েছিল সভার। স্কুলের পরিবেশ যাতে বৈষম্যমুক্ত, সংবেদনশীল হয়, তার জন্য শিক্ষকেরা কী ধরনের পাঠ্য, প্রকরণ ও পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন, তা নিয়ে দফায় দফায় কথাবার্তা হল। এ বিষয়ে নানা পাঠ্যবই ও পোস্টারের প্রদর্শনীও ছিল। বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থা সেগুলি প্রকাশ করেছে। আলোচনার উদ্যোক্তা ছিল ‘এবং আলাপ।’ সংস্থাটি জেন্ডার-সংবেদনশীল শিক্ষাব্যবস্থার জন্য নানা জেলার স্কুলে কাজ করছে।

এসি-র হাওয়াতে ঠান্ডা ঘরের পরিবেশটা ক্রমশ একটু একটু করে পাল্টাতে লাগল, যখন শিক্ষকশিক্ষিকারা তাঁদের অভিজ্ঞতা বলতে লাগলেন। বিদ্যালয় এক ‘মিনিয়েচার সোসাইটি’— বলা চলে, সমাজের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। সমাজে যা কিছু পক্ষপাত, বৈষম্য, তার প্রতিফলন পড়ে স্কুলেও। ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা কমন রুম, আলাদা মিড-ডে মিলের খাবার ঘর, বা খেতে বসার আলাদা সারি, ছেলেদের দিয়ে মাঠ পরিষ্কার, মেয়েদের দিয়ে আলপনা দেওয়া, এমন নানা ধরনের বিভাজন চলতে থাকে। এবং, এমন পার্থক্যকে ‘সমস্যা’ বলে না ভেবে ‘স্বাভাবিক’ বলে ভাবতেই অভ্যস্ত অধিকাংশ শিক্ষক।

অনেকে মুখে বলেন, ‘আমি ছেলে-মেয়ে পার্থক্য করি না,’ কিন্তু মেয়ে কম্পিউটার কিনতে চাইলে হারমোনিয়াম বা গয়নার অফার করেন, আক্ষেপ করলেন এক শিক্ষক। সমাজের অভ্যাস প্রভাবিত করে বিদ্যালয়ের পরিবেশকেও। ছেলেমেয়েদের মধ্যেও শৈশব-কৈশোরেই এই পার্থক্যের বোধ ঢুকে যায়। সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে, এমন এক ছাত্র ও ছাত্রীকে এক বার প্রশ্ন করেছিলেন শিক্ষকেরা। ছেলেটি স্পষ্ট বলে, ‘তাতে কী ম্যাডাম! আমি তো ছেলে।’ মেয়েটি কেঁদে ফেলে কাউকে না জানানোর অনুরোধ করতে থাকে বার বার। হাই স্কুলেই এমন ভাবে জেন্ডার-নির্মিতি স্পষ্ট।

আর একটি প্রসঙ্গ বার বার উঠে এল জেন্ডার-সম্পর্কিত আলোচনায়, তা হল তৃতীয় লিঙ্গ। তাদের প্রতি শিক্ষক ও সহপাঠীদের আচরণ কেমন হওয়া দরকার? তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি অন্যদের রাগ, বিরক্তি, তাদের অপমান, বিদ্রুপ করার ঝোঁক, সবই দেখেছেন শিক্ষকরা। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা বিষয়টি এড়িয়ে যান। মফস্সলের একটি স্কুলের শিক্ষক অবশ্য বললেন, এক ছাত্র উঁচু ক্লাসে ওঠার পর শাড়ি পরার ইচ্ছা জানালে তাঁরা সেই অনুমতি দিয়েছেন। সে মেয়েদের বাথরুম ব্যবহার করার সময়ে কিছু বান্ধবী তার সঙ্গী হয়, যাতে তাকে অস্বস্তিতে পড়তে না হয়। এইটুকু অন্তত ওই স্কুল করতে পেরেছে।

নিজের জীবনেও বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছেন অনেকে। এক মুসলিম শিক্ষিকা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে নিজের চেষ্টায় উচ্চশিক্ষিত হন। কিন্তু কেবল পুরুষ অভিভাবক সঙ্গে নিতে চাননি বলে হজ যাত্রার অনুমতি পাননি। সেই অন্যায় প্রত্যাখ্যানের কথা তিনি আগে কোথাও বলতে পারেননি, জানালেন শিক্ষকদের এই সভায়। এক হিন্দু শিক্ষিকা বলেন পর পর দুটি মেয়ে হওয়ায় কী ভাবে তাঁকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে পরিবারে, এখন ‘ডিভোর্সি’ হওয়ায় তাঁর কত বদনাম।

তবে কি এমনটাই চলবে? বৈষম্যের ধারাপাতে মেয়েরা, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা কি আত্মপ্রত্যয়হীন, বিষাদগ্রস্ত হয়েই বাঁচবে? ছেলেরা নিজেদের ‘হিরো’ ইমেজ নিয়ে ঘুরবে চিরকাল? নাকি শিক্ষায়, স্কুলের পরিবেশে পরিবর্তন হবে? জেন্ডার-বৈষম্যের যে বীজ প্রোথিত আছে সিলেবাসে, স্কুলের ব্যবহারিক বিধিতে, বা প্রচলিত সামাজিক অভ্যাসে, তাকে সমূলে নাশ করতে হবে, সে বিষয়ে আলোচনায় সবাই একমত হলেন।

কিন্তু কী ভাবে তা বাস্তবে রূপায়িত করা সম্ভব? পাঠদানে পরিবর্তন, নতুন নতুন পাঠ্যবই বা ‘অ্যাক্টিভিটি’-মূলক পাঠ, শিক্ষকদের নিয়ে জেন্ডার বিষয়ক আলোচনা, ক্লাসে জীবনশৈলী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, কী কাজ দেবে বেশি? তার মীমাংসা সহজ নয়, কিন্তু নতুন পথে যে হাঁটা দরকার, সে প্রত্যয়টা বেশ টের পাওয়া গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE