শিশুদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ফাইল ছবি
কবি গোলাম মোস্তাফা তাঁর ‘কিশোর’ কবিতায় লিখেছিলেন ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’। ‘শিশু’দের মধ্যেই রয়েছে আগামীর সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনার বিকাশের জন্য যাই উপযুক্ত পরিবেশ। কাল চলে গেল শিশুদিবস। এমন দিনে সেই সম্ভাবনার দিকে ফিরে তাকানো যায়।
আমরা সবাই জানি শিশুদের নিজস্ব জগত রয়েছে। রয়েছে নিজেদের চাওয়া, পাওয়া। অনেক সময় আমরা সচেতন ভাবে তাদের চাওয়া, পাওয়াকে গুরুত্ব দিই না। তাদের প্রতি দ্বায়িত্ব পালনে কিছুটা হলেও উদাসীন থাকি। অথচ এরাই আগামী সমাজের নাগরিক। এদের মঙ্গলের কথা সবার আগে ভাবা দরকার। শিশুদের সুস্থ ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য তাদের অধিকার ও চাহিদা সম্পর্কে প্রাপ্তবয়স্কদের সব সময়ে সজাগ থাকতে হবে— এমন কথাই বলছেন বিশেষজ্ঞেরা। আর তা আবশ্যকও। স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অন্য সুযোগসুবিধা সম্পর্কে দেশে কী কী প্রকল্প রয়েছে এবং কী ভাবে এরা তার সুযোগ পেতে পারে সে বিষয়ে বড়দের সব সময় সচেতন থাকা জরুরি।
তবে শিশুদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি বলছেন শিশুদের অধিকার ও মানসিকতা সম্পর্কে সচেতনতা কেবল শিশুদিবসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। সারা বছর যাতে এই কর্মকাণ্ডের ধারা অব্যাহত থাকে তার জন্যও সচেতনতা জরুরি। সেই প্রতিজ্ঞাই করা দরকার শিশুদিবসে। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু শিশুদের উন্নতি ও বিকাশের জন্য একগুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। নেহরুর সময় থেকে শিশুদের বিকাশের জন্য যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল সেগুলির উত্তরাধিকার বর্তমান নাগরিক এবং প্রশাসনের উপরে। তাই এই কাজে সরকার ও অভিভাবকদের আরও বেশি করে এগিয়ে আসতে হবে।
তবে শুধু ভারত নয়, বিশ্বের বহু দেশেই নভেম্বরে শিশুদিবস পালিত হয়। নভেম্বরের প্রথম শনিবার দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং নভেম্বরের অন্য দিনগুলিতে ক্রোয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, ইজ়রায়েল, ইথিওপিয়া, নেদারল্যান্ড, কানাডা, কেনিয়া, গ্রিস, প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, মিশর, স্লোভেনিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, সাইপ্রাস, সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, স্পেন ইত্যাদি দেশে শিশু দিবস পালিত হয়ে থাকে। ২০ নভেম্বরকে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ‘আন্তর্জাতিক শিশুদিবস’-এর স্বীকৃতি দিয়েছে।
শিশুদের বাসযোগ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তোলা, পর্যাপ্ত খাদ্য, বাসস্থানের পাশাপাশি, তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির সুবন্দোবস্ত করা শিশুদিবসের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু বাস্তব বলছে এই দিনটি বিশ্বের নানা দেশে ঘটা করে পালিত হলেও এখনও ভারত-সহ তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে শিশুরা অন্ন, বাসস্থান, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের দেশে গ্রামের পাশাপাশি, শহরেও অনেকে দারিদ্র সীমার নীচে বাস করেন। এই সব পরিবারের শিশুদের স্কুলমুখী করতে, তাদের পর্যাপ্ত পুষ্টির ব্যবস্থা করতে সরকার বেশ কিছু জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘মিড-ডে মিল’ একটি বড় পদক্ষেপ। এর ফলে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার কিছুটা হলেও কমেছে। কিন্তু শিশুদের নিয়ে কাজ করা একাধিক সমাজকর্মীর দাবি, সরকারি এই সুযোগসুবিধাগুলি সব জায়গায় সমান ভাবে বণ্টিত হচ্ছে না। ফলে এখনও শিশুদের একটি অংশের শিক্ষা ও পুষ্টির ঘাটতি রয়েছে ।
নানা সরকারি সুযোগসুবিধা থাকা সত্ত্বেও আজও শিশুদের একটি অংশের কাছে স্কুলে যাওয়া অনেকটা স্বপ্নের মতো। খুব বেশি দূর যেতে হবে না, আমাদের আশেপাশেই এমন শিশুদের দেখা মিলবে। কাছের ইটভাটা, চায়ের দোকান, রাস্তার ধারে খাবার দোকানে এমন শিশুদের দেখা মেলে। ভারতে এমন শিশুর সংখ্যা কম নয়। এটা রীতিমতো উদ্বেগের বিষয়। শুধু কম বয়সে কঠোর পরিশ্রমই নয়, সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে এই সব শিশুরা প্রতিনিয়ত দৈহিক ভাবে লাঞ্ছিতও হচ্ছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও জটিল। শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করাই নয়, মেয়েদের নাবালিকা অবস্থায় বিয়েও দিয়ে দেওয়া হয়। যা তাদের শরীর ও মনের উপরে চাপ তৈরি করে। ভবিষ্যত সমাজের পক্ষেও তা ক্ষতিকারক। কেন্দ্র ও রাজ্যে— দুই সরকারই এই সমস্যার সমাধান করতে উদ্যোগী হয়েছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ বা রাজ্য সরকারের কন্যাশ্রী প্রকল্প এই ক্ষেত্রে সদর্থক পদক্ষেপ। তবে এখানে আরও সক্রিয়তা জরুরি।
এত গেল দারিদ্রের কারণে শিশুদের একাংশে মধ্যে শিক্ষা ও পুষ্টির ঘাটতির কথা। কিন্তু মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারে যে শিশুরা বেড়ে উঠছে তারও কি ভাল আছে? পুষ্টির অভাবে তারা ভোগে না। শিক্ষার অভাবও নেই। এই অংশের শিশুদের একটি বড় অংশ আজ বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে। আর এখানে থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে ইঁদুরদৌড়। এর পিছনে স্কুল ও পরিবারের যৌথ ভূমিকা রয়েছে। সব সময়ে সামনের সারিতে থাকার জন্য জোর দেওয়া হচ্ছে। মনোবিদদের একাংশ জানাচ্ছেন, অতিরিক্ত চাপ শিশুদের মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। চাপ সহ্য করতে না পেরে শিশুরা আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে।
এই আলোচনার মধ্যে আরও এক শ্রেণির শিশুর কথা হারিয়ে যায়। এরা হল ‘অন্যভাবে সক্ষম’ শিশুরা। অনেকে এদের সমস্যাগুলিকে সহানুভূতি দিয়ে বিচার করতে চান না। কিন্তু এরাও সমনাধিকারে দাবিদার। সুস্থ সমাজ এদের বিকাশের সব রকম সুবিধা করে দেয়। অবহেলায় কখনও দূরে সরিয়ে রাখে না। এর জন্য দরকার সংবেদনশীলতা। সরকার এদের নিয়ে ভেবেছে। ভেবেছে বলেই শিক্ষাক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা, নানা ধরনের স্কুল চালু করা-সহ একগুচ্ছ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সবাই এই সুযোগ সম্বন্ধে অবহিত নন। সাধারণকে সচেতন করা এবং সংবেদশীল করে তোলাও সরকারের দায়িত্ব। এই পৃথিবীকে শিশুদের বাসযোগ্য করতে গেলে এ দিকে নজর দেওয়া আশু প্রয়োজন।
লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy