আলোচনারত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি।—ফাইল চিত্র।
কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে শুধুমাত্র এই দমননীতিই কি সমাধানের স্থায়ী পথ? মতাদর্শগত ভাবে এই বিতর্কটা নতুন নয়। অতীতে অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনও বিজেপি-আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবারের মতাদর্শ ছিল, কাশ্মীরে সন্ত্রাসদমনের জন্য চাই জবরদস্ত প্রশাসন। কাশ্মীরে যখন জগমোহন রাজ্যপাল ছিলেন তখন তাঁরও লাইন ছিল সেনা ও আধা সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে কাশ্মীরের সন্ত্রাস দমন। মূলত সেই রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিভূমি একটি ধারণা বা সাপোজিশনের উপর দাঁড়িয়েছিল। সেটি হল, কাশ্মীরিদের মদত দিচ্ছে পাকিস্তান। অতএব কাশ্মীরে শান্তি আনতে গেলে চালাতে হবে সেনা অভিযান। তবে বাজপেয়ী জমানায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী এই কঠোর লাইনের প্রবক্তা থাকলেও সে দিন কিন্তু কাশ্মীরে শান্তি প্রক্রিয়ার প্রচেষ্টাও খোলা রাখা হয়েছিল। বাজপেয়ী জমানায় তাঁর গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং-এর (র) প্রধান ছিলেন দুলাত। তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত কাশ্মীর সংক্রান্ত বইতে দুলাত দেখিয়েছেন, নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রথম হুরিয়াত নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। বাজপেয়ী সেই রাজনৈতিক শান্তি প্রক্রিয়াকে সক্রিয় রাখেন। সন্ত্রাস দমনের পাশাপাশি আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে।
আজ কাশ্মীর নীতিটাই মোদী সরকার বদলে ফেলতে চাইছে। রাষ্ট্রের ‘নীতির পুনর্গঠন হচ্ছে।’ জগমোহন তাঁর বই ফ্রোজেন টার্বুলেন্স-এ বলেছিলেন, সন্ত্রাসের অশান্তিকে বরফের মতো যুগযুগ ধরে জমিয়ে তোলা হয়েছে এবং চিরকালের মতো এই অশান্ত অস্থিরতার সমাপ্তি।
ভারতীয় রাষ্ট্রের পুনর্নির্মাণের সঙ্গে বিজেপি সরকারের নতুন কাশ্মীর নীতি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ভারতের নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধে এ ভাবে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে প্রবুদ্ধ হওয়া সহজ কাজ নয়। মেহবুবা মুফতি-র পিডিপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাশ্মীরে সরকার গড়েছে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা এবং কাশ্মীর শুধু নয়, দেশের বিদ্বৎসমাজের একাংশ মনে করেছিলেন হয়তো কাশ্মীরে বিজেপি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করতে আগ্রহী। সঙ্ঘ পরিবারের লাইন কিন্তু ছিল ভিন্ন। এই প্রথম কাশ্মীরে বিজেপি এক নির্ধারক শক্তি। সুতরাং শুধু জম্মুর উদ্বাস্তু পন্ডিতদের সুরে সুর মেলানো নয়, সামগ্রিক ভাবে কাশ্মীরে বিজেপির নিজস্ব নীতির প্রয়োগ করা। যেমন, অনুচ্ছেদ ৩৭০ ধারাকে কাশ্মীরে অবলুপ্ত করতে হবে। মেহবুবার সরকারের সঙ্গে থাকলে আনুষ্ঠানিক ভাবে সে প্রস্তাব বাস্তবায়িত করা যায় না। কিন্তু প্রকাশ্যে বিজেপি-আরএসএস সে কথা বলে কাশ্মীরে মেহবুবাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলছে বটে কিন্তু গোটা দেশে নিরপেক্ষ হিন্দুসমাজের কাছেও বিজেপির জনপ্রিয়তা এ কারণে বাড়ছে।
কিন্তু কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ী সমাধান কি এ পথে হবে? আমার মনে হচ্ছে, এ ভাবে এ পথে চললে গোটা দেশ জুড়ে সন্ত্রাস ও পাকিস্তান বিরোধী জিগির গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু এর ফলে কাশ্মীরিদের বিচ্ছিন্নতা আরও বাড়বে। ভারত রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনের ভিতর পাকিস্তান তার স্বার্থ চরিতার্থ করার সুযোগ বেশি পাবে। মেহবুবা মুফতি আমাকে বলেছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যখন মধুর থাকে তখন কাশ্মীরেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত সরকার সংঘাতের পথে গেলে কাশ্মীর অশান্ত হয়ে ওঠে। এই কথাটাও বুঝতে হবে। হুরিয়ত থেকে হিজবুল, পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রণ বাড়তে আমরা কেন সক্রিয় হচ্ছি? প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও পরোক্ষ ভাবে?
বিএসএফের প্রাক্তন ডিজি রামমোহন কেরলের লোক। তিনি আডবাণীর সময় ডিজি হন। সন্ত্রাস দমনে কঠোরনীতিতেই চিরকাল বিশ্বাস করতেন তিনি। বিরাট মোচওয়ালা এই মানুষটির সঙ্গে ঢাকা গিয়ে দেখেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত এক সেমিনারে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের শক্ত ভূমিকা নিয়ে এমন কঠোর অবস্থান নেন যে ঢাকার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে রীতিমতো তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রকাশ্যেই। এ হেন রামমোহন ভারত সরকারের আজকের কাশ্মীরনীতি নিয়ে কিন্তু খুশি নন। বরং সন্দিগ্ধ। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মুসলিম বিরোধী হিন্দুত্বর দৃষ্টিভঙ্গি কাশ্মীরে গ্রহণ করলে তাতে সমস্যার সমাধান হবে না। এটি আরও ক্ষতিকর হবে।
কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে তাই আজকের রাষ্ট্রীয় নীতি, আলাপ-আলোচনার আর কোনও জায়গাই নেই। এই পথেই এক ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’ গড়ে তুলতে তৎপর বিজেপি। বিজেপি নেতারা বলছেন, এ তো সবে কলির সন্ধে। এখনও অনেক দূর পথ যেতে হবে। আমি শঙ্কিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy