শ্রীলঙ্কা ও ভারতকে স্থলপথে জুড়তে ‘হনুমান সেতু’-র প্রস্তাব কলম্বো কি মেনে নিয়েছে? ত্রিঙ্কোমালি বন্দর গড়তে ভারতের সাহায্য কেন নেওয়া হচ্ছে? কলম্বো নয়াদিল্লি-র বাণিজ্যচুক্তিতে কী কী শর্ত আছে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শ্রীলঙ্কা সফরের আগে থেকেই কলম্বো আলোড়িত করে প্রশ্নগুলি তুলছিল শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট মহেন্দ্র রাজাপক্ষ-র নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বিরোধী জোট। শ্রীলঙ্কার বিরোধী জোটের আক্রমণকে উপেক্ষা করে ‘বন্ধু’ সিরিসেনা এবং রনিল সিংহের সরকারকে ‘সাহায্য’ করতে নয়াদিল্লি যে সদাতৎপর, তা বোঝাতে চেষ্টার কসুর করা হয়নি। কেন প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা (ছবিতে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে) এবং প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহের সরকারকে ‘বন্ধু’ বললাম? প্রেসিডেন্ট মহেন্দ্র রাজাপক্ষ-র আমলে শুধু যে কলম্বো-র বেজিং-এর সঙ্গে ‘সখ্য’ নয়াদিল্লিকে উদ্বেগে রেখেছিল তা নয়, রাজাপক্ষ-র আমলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও যথেষ্ট চিন্তাজনক ছিল। ২০০৯ সালে সেনা অভিযান চালিয়ে রাজাপক্ষ শুধু এলটিটিই বা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণকে খতম করেননি, শ্রীলঙ্কার তামিলদেরও সেনাবাহিনীর বুটের নীচে পাঠিয়েছিলেন। রাজাপক্ষ অনুগামীদের অভিযোগ, তাই জন্য ভারতের ‘অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে’
২০১৫-র নির্বাচনে আচমকাই সিরিসেনা তৎকালীন প্রেসিডেন্টকে চ্যালেঞ্জ জানান ও সবাইকে হতচকিত করে দিয়ে জিতে আসেন। শ্রীলঙ্কার নির্বাচনে ‘কলকাঠি’ নাড়ার এই অভিযোগ ঘিরে কলম্বোয় তখন তুমুল বিতর্ক হয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ‘বন্ধু’ সরকারের আমন্ত্রণে মোদী শ্রীলঙ্কা ঘুরে এলেন। কলম্বো কিংবা ক্যান্ডি সেই জন্য সেজে ছিল ভালই। সুদৃশ্য ‘ম্যাজিক ল্যান্টার্ন’-এ ছেয়ে গিয়েছিল বিমানবন্দর। কলম্বো-র অভিজাত ‘ফোর্ট’ এলাকা মুড়ে দেওয়া হয়েছিল শ্রীলঙ্কার জাতীয় পতাকার পাশাপাশি ভারত ও নেপালের পতাকায়। অভিজাত ‘ফোর্ট’ এলাকা ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে গেলেই পেটাহ। কলম্বোর বাণিজ্য কেন্দ্র, সুদৃশ্য— ইউরোপীয় মেজাজের কলম্বোর মধ্যে ব্যতিক্রমী। পেটাহ-র ব্যবসাবাণিজ্যের বেশিটাই মুসলিম ও তামিলদের নিয়ন্ত্রণে। মুসলিমরা সেই অষ্টম শতাব্দীর আরব বণিকদের উত্তরাধিকারকে বহন করে চলেছে। সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী তামিল ও মুসলিমরা অবশ্য জানেন, বাণিজ্যের অধিকার তাঁদের থাকলেও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সংখ্যাগুরু সিংহলি বৌদ্ধদের হাতেই।
পেটাহ-র ব্যবসায়ী শিবরামকৃষণ বলছিলেন, “রাজাপক্ষ ছিল স্বৈরতান্ত্রিক শাসক। সিরিসেনা-র আমল অনেক ভাল। আমরা মুখ খুলতে পারছি।” শুধু মুখ খোলা নয়, ২০১৬-র ৪ ফেব্রুয়ারি শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রথম বার তামিল ভাষায় গাওয়া হয়েছে শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত। তামিল জাতীয়তাবাদকে এইটুকু স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়াও উত্তর শ্রীলঙ্কার তামিল অধ্যুষিত এলাকায় ভারতীয় বিনিয়োগে পরিকাঠামো ঢেলে সাজানোতে আগ্রহী সিরিসেনা সরকার। গত মাসে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহের ভারত সফরের সময়ই ঠিক হয়ে গিয়েছে জাফনা থেকে মান্নার, মান্নার থেকে ভাভুনিয়া, ভাভুনিয়া থেকে ত্রিঙ্কোমালি এবং ত্রিঙ্কোমালি থেকে ডামবুলা পর্যন্ত রাস্তা তৈরি হবে। তখনই ভারতের প্রস্তাবিত ‘হনুমান সেতু’ নিয়ে কলম্বোয় বিতর্ক শুরু হয়। পার্লামেন্টে প্রবল হইচই-এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে বিবৃতি দিতে হয়।
রাম অনুগামীদের জন্য ‘হনুমান সেতু’ হোক বা না হোক, তামিলদের অধিকারের কী হবে? সংখ্যালঘু তামিলদের অধিকার, সুশাসন এবং উন্নয়নের জন্য যে সময়সীমা নয়াদিল্লি এবং কলম্বো মিলে ঠিক করেছিল, তার ভবিষ্যৎ কী? রাজাপক্ষর আমলে হওয়া ‘গুপ্তহত্যা’র বিচার হবে? রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাব বলছে, শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী বনাম এলটিটিই-র লড়াইয়ে ১২ হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে। ইউনাইটেড নেশনস-এর হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল হয়েছে ১৯৮০ সালে। তার পর থেকে তারা যে রিপোর্ট তৈরি করে, তাতে নিখোঁজদের হিসাবে গোটা বিশ্বের মধ্যে শ্রীলঙ্কার স্থান দ্বিতীয়। আফ্রিকার অনেক দেশের থেকেও প্রতিবেশী এই দ্বীপরাষ্ট্রের মানবাধিকারের ‘রেকর্ড’ খারাপ বলে মনে করে রাষ্ট্রপুঞ্জ। একাধিক প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। কিন্তু ২০১৩-য় সেখানকার মানবাধিকার কমিশনার আসেন যখন, তখন যে মানবাধিকার কর্মীরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান, পুলিশ তাঁদেরই হেনস্তা করছিল বলে অভিযোগ।
সে সময় ১৫ জন সাংবাদিক এবং সম্পাদক খুন হয়েছেন। তার মধ্যে একজন বিখ্যাত সংবাদপত্র সম্পাদক খুন হওয়ার ঘটনায় মহেন্দ্র রাজাপক্ষ ঘনিষ্ঠ একজন গোয়েন্দা অফিসারকে কিছু দিন আগে গ্রেফতার করেছে সিরিসেনা প্রশাসন। এই যখন অবস্থা, তখন শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলি নিজেদের অধিকার এবং অস্তিত্ব রক্ষার দাবিতে যে ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। শ্রীলঙ্কার তামিলদের জন্য সুখবর, এই বছরেরই ১২ জুন ইউনাইটেড নেশনস-এর হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল-এ তাঁদের প্রসঙ্গে বলবেন তামিলনাডুর নেতা এম কে স্ট্যালিন। কিন্তু স্ট্যালিন তো চেন্নাই-এর প্রতিনিধি। দ্বীপরাষ্ট্রে মানবাধিকার ও সংখ্যালঘু অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে নয়াদিল্লি কী চায় সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ বারের সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আলাদা করে শ্রীলঙ্কার চা-শ্রমিকদের সমাবেশে ভাষণ দিলেন। শ্রীলঙ্কার এই চা-শ্রমিকরা প্রায় সবাই তামিল বংশোদ্ভূত। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য কলম্বোকে খুশি রাখার প্রতিযোগিতায় চিন-ভারতের টক্করের মধ্যেও শ্রীলঙ্কায় সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়টি দিল্লি একেবারে ভুলে যায়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy