চাষের এবং চাষির উন্নতির পথ খুঁজতে হবে, সেটা আগেই বলেছি। (‘কৃষির সমস্যা...’, ২১-৭) কয়েকটি বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার। প্রথমত, উৎপাদন প্রযুক্তি ও তার সম্প্রসারণ। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থা সব থেকে করুণ। আমাদের সরকারি সম্প্রসারণ ব্যবস্থা খারাপ না, কিন্তু তারা কী সম্প্রসারণ করবে? এ জন্যে দায়ী এ দেশের কৃষি-গবেষণা ও কৃষি-শিক্ষার চূড়ান্ত ব্যর্থতা এবং সরকারি ও বেসরকারি উদাসীনতা। ফলস্বরূপ, বিগত দশ বছরে ফল, ফুল, সবজি, ইত্যাদির যত নতুন জাত বা ফসল আমাদের দেশে এসেছে তার একটা বড় অংশ এসেছে তাইল্যন্ডের মতো ছোট্ট একটা দেশ থেকে। কোনও নতুন প্রযুক্তি সম্বন্ধে সাবেকি চাষিদের বা সম্প্রসারণ-কর্মীদের কোনওই ধারণা নেই, এমনকী সদ্য জেগে ওঠা হবু শহুরে চাষারাও এঁদের কাছ থেকে কোনও সাহায্যই পান না। ফলে ‘নেট-নির্ভর’ হয়ে ‘অর্ধ-প্রযুক্তি’ নিয়ে এঁরা দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছেন। ভাবতে পারেন, এ দেশের ১ শতাংশ চাষিও জমির পি-এইচ, মাটির-জল, নিজে মাপতে পারেন না! অথচ এই দুটো মাপার জন্য চিনে তৈরি যন্ত্রের দাম বেশি হলে ২০০০ টাকা। আর মাটির এনপিকে, জৈববস্তু, ইত্যাদি পরিমাপ করা শিখতে যে চাষির আরও কত বছর লাগবে কে জানে।
অতঃ কিম্। আইসিএআর, আইএআরআই, ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাজকর্মের ধারা একেবারে ঢেলে সাজতে হবে। এ ভাবে জনগণের টাকার অপচয় আর চাষির দুর্দশা একসঙ্গে চলতে দেওয়া যায় না। চাষিদের এখনই প্রায়োগিক প্রযুক্তি দরকার, তাই এদের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিতে হবে। এদের হাত থেকে পরিচালন ব্যবস্থা নিয়ে নিতে হবে। প্রফেসর নয়, অভিজ্ঞ প্রফেশনালদের নীতি নির্ধারণে যুক্ত করতে হবে, তা হলে যদি কৃষি-প্রযুক্তি ও গবেষণাকে চাষির প্রয়োজনের দিকে চালিত করা যায়। এটা কিন্তু করতেই হবে, না হলে কৃষিতে এগনো যাবে না।
দ্বিতীয়ত, ভর্তুকি। দেশের ভর্তুকি ব্যবস্থা অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় কৃষির সব থেকে বেশি ক্ষতি করেছে। আমাদের দেশে কৃষিতে ভর্তুকি সব সময়েই ভুল নীতি দ্বারা পরিচালিত। চাষি সারে, ডিজেলে, ঋণের সুদে, বীজে, ট্রাক্ট্রর ইত্যাদিতে, নানা রকম সেচ ব্যবস্থায়, সহায়ক-মূল্যে ফসল ক্রয়ে, হরটিকালচারে, গ্রিনহাউস স্থাপনে— এমন নানা বিষয়ে ২৫% থেকে ৯০% পর্যন্ত ভর্তুকি পেতে পারেন। এখন প্রশ্ন হল, মোট কত জন ভর্তুকি পায়, আর কাদের সত্যিকারের বা সরাসরি লাভ হয়?
চাষির নাম এই লিস্টে ওঠা থেকে রাজনীতি ও টাকার খেলা শুরু। কিছু ক্ষেত্রে চাষির নামের ওই ভর্তুকি সবাই পায়, যেমন ডিজেল-এ। কিন্তু সারে, ট্রাক্ট্ররে, পাওয়ার-টিলারে, পাম্প-সেটে ও নানা সেচ ব্যবস্থায় (এমনকী বড়-বাঁধ প্রকল্পেও) ওই ভর্তুকি থেকে সরাসরি যাঁদের লাভ হয় তাঁরা হলেন সংশ্লিষ্ট কোম্পানি, ঠিকাদার, ব্যাংক ও সরকারি আধিকারিক, বড় জোতদার, চাকরি-নির্ভর চাষি, ইত্যাদি। সাধারণ চাষি এ সব থেকে প্রযুক্তিগত লাভ তুলতে পারেন না, আর ঋণের বোঝা থাকলে তো কথাই নেই।
তা হলে উপায় কী? এক, আগে কাজ বা ব্যবহারের প্রমাণ দিতে হবে, পরে ভর্তুকির আবেদন (সার, ডিজেল, সব ক্ষেত্রেই) গ্রাহ্য হবে। দুই, কোম্পানি, ঠিকাদার, ব্যাংক, কাউকেই ভর্তুকি দেওয়া যাবে না, ভর্তুকি যাবে সরাসরি চাষির কাছে (বর্তমান সরকার সে চেষ্টা করছে)। তিন, অবস্থাপন্ন ও ব্যবসা/চাকরি-নির্ভর চাষি (সরকারি মানদণ্ড অনুসারে) ভর্তুকি আওতার বাইরে থাকবেন। চার, উৎপাদন-নির্ভর (ফসল, ফলন ও তার গুণমানের নিরিখে) ভর্তুকির অনুপাত বাড়াতে হবে। পাঁচ, সহায়ক-মূল্যে ফসল ক্রয় বন্ধ করে চাষিকে প্রতিযোগিতায় যেতে বাধ্য করতে হবে। ছয়, রফতানিতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে।
তৃতীয় বিষয় হল বাজার ও চাষির আইনানুগ যোগ। যে কোনও বিক্রি-ব্যবস্থা, ফসল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ, ইত্যাদি ব্যবসার পরিচালন ব্যবস্থায় চাষিকে সঙ্গে নিতে হবে। অর্থাৎ ওই সব ব্যবসার মালিকদের সরকারি নির্দেশ মতো সর্বনিম্ন নির্দিষ্ট সংখ্যক (ওই ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত) চাষিকে সঙ্গে নিতেই হবে। প্রয়োজনে এর জন্যে আইন প্রণয়ন করতে হবে। এর ফলে চাষির আত্মবিশ্বাস এবং ব্যবসাদারের বিশ্বাসযোগ্যতা, দুটোই বৃদ্ধি পাবে। তা হলে প্রযুক্তির বিকাশেরও সুবিধা হবে।
হ্যাঁ, কৃষিকে বাঁচাতে হলে অনেকগুলো কাজ করতেই হবে। সত্যিকারের কাজ, গোঁজামিল কিছু হলে হবে না। না হলে প্রতিবাদ বিক্ষোভের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতেই থাকবে, লাভা স্রোতের মতো নিত্যনতুন জ্বালামুখ তৈরি করতে থাকবে, সারা দেশে। গুলি করে, ১৪৪ ধারা দিয়ে তা বন্ধ করা যাবে না।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy