কামদুনির ছাত্রীকে গণধর্ষণ ও নৃশংস হত্যার শাস্তি হল তিন জনের ফাঁসি, তিন জনের যাবজ্জীবন, দু’জন বেকসুর খালাস। কামদুনির মানুষ, বিশেষত মেয়েরা খুশি, কিন্তু নিশ্চিন্ত নন আদৌ। নিশ্চিন্ত নই আমরাও, যারা নিহত ছাত্রীর জন্য সুবিচার চেয়ে সরব ছিলাম। এই ছাত্রী কামদুনি গ্রাম থেকে প্রথম স্নাতক স্তর পর্যন্ত গিয়েছিলেন। নিহত ছাত্রীটি সুবিচার পেলেন, কিন্তু কামদুনির মেয়েরা কি ন্যায্য বিচার পেলেন? এই রায় কি নিশ্চিন্ত করেছে আরও অনেক মেয়েকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে, কাজ করতে, সব কিছুর সঙ্গে জীবনের আনন্দস্ফূর্তিতেও সমান তালে যোগ দিতে? না, করেনি। প্রত্যাঘাতের ভয়ে মেয়েরা সন্ত্রস্ত— এ কি সুশাসনের পরিচায়ক? সেখানে মেয়েদের স্কুলের পরে পড়তে পাঠানো হচ্ছে না, অনেক মেয়েকেই তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তারা জানছে না আনন্দের কন্যাকাল। অনেক পরিবার বাকিদের না জানিয়ে নিজের জমিবাড়িটুকু বেচে দিয়ে চলে যাচ্ছেন, যাঁরা পড়ে থাকছেন তাঁরা আরও আরও একা হয়ে যাচ্ছেন, মাথা উঁচু করে মাটি আঁকড়ে থাকার ক্ষমতা কোথায় পাবেন?
ওই গ্রামের মানুষরা তাঁদের ভয়, আশঙ্কা উচ্চকণ্ঠেই প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কোনও প্রশাসন, কোনও রাজনৈতিক দল বলেনি যে তারা তাঁদের নিশ্চিন্তে নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করবে। টুম্পা-মৌসুমীদের গিয়ে পুলিশ ক্যাম্পটিকে স্থায়ী করার দাবি কেন জানাতে হয়েছে? কেন এখনও পঞ্চায়েতের মাথারা, সভাধিপতি থেকে শুরু করে প্রধান, সব সদস্যরা এসে ওই গ্রামে সভা করে হোক, বাড়ি বাড়ি গিয়ে হোক, জানাতে পারছেন না যে, তাঁরা এ বার থেকে নিয়মিত নজর রাখবেন যাতে কোনও প্রত্যাঘাত না আসে? বুক বাজিয়ে সেই কথাটা কেন কেউ গ্রামের মেয়েদের বলছেন না? কেন আসছেন না রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে শাসক দলের নেতারা? একটা জনশ্রুতি ছিল যে, কোনও এক জনপ্রতিনিধি নাকি ঘোষণা করেছেন, নির্বাচনের আগে দুটোকে ফাঁসিতে ঝোলাবেনই। মামলার রায়দানের সময়টা তাৎপর্যপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, কামদুনির মেয়েদের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িয়ে শুধু কামদুনির নয়, রাজ্যের মেয়েদের ভবিষ্যৎ। সেটা নির্বাচনী তরণী বানিয়ে তার পর তাঁদের ভুলে যাবেন না যেন।
একটু কামদুনির ভূগোলটা মনে করি। বারাসতের রিঙ্কুর মতো রাত এগারোটায় স্টেশনে আনতে সাইকেলে চেপে যাওয়ার মতো ঘটনার থেকেও কামদুনির ছাত্রীটির ঘটনা আরও ভয়াবহ, কারণ এটি এমন একটি জায়গা, যেখানে একটি মেয়ের দুপুর আড়াইটেতেই পড়ে ফিরতে গেলে কোনও পুরুষ দেহরক্ষী লাগে, ভাই-কাকা-দাদা-বাবা। এটা পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গায় নিয়মিত ঘটনা, উত্তর ২৪ পরগনাও নিয়মের বাইরে নয়। এই কলেজ-ছাত্রীর চলাফেরায় নিশ্চয়ই নিয়মিত নজর রেখেছিল তাঁর ধর্ষকরা— কখন যায়, কখন ফেরে, কখন সুরক্ষিত, কখন অরক্ষিত। তাই এক বৃষ্টির দিনে তাঁর ভাই সাইকেল নিয়ে আসতে একটু দেরি করেছে, বৃষ্টিতে ভাই আসছে না ভেবে হাঁটতে শুরু করেছেন, ঠিক তখনই তাঁকে সহজ শিকারে পরিণত করল ধর্ষকরা। একটি গ্রামের মেয়ে মরে গিয়ে অন্য গ্রামের পুরুষদের ‘ফাঁসিয়ে’ দিচ্ছেন, এই ঘটনা তো তা নয়। তা হলে ধর্ষকদের পরিবারের প্রতি জনপ্রতিনিধিদের এত মমতা কেন? কী কারণে?
একটা কথা বলা দরকার। কামদুনির ঘটনা হল একমাত্র ক্ষেত্র, যেখানে ধর্ষকদের পরিবার-পরিজন মঞ্চ তৈরি করতে পেরেছেন, পুলিশি প্রহরায় নবান্নে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে স্মারকলিপি তুলে দিতে পেরেছেন। পুরো বিচারপর্বে তাঁদের কথাবার্তাই শোনা গেছে, তাঁরা বারাসত কোর্ট থেকে মামলা সরানোর আবেদন করেছেন, এই রায় না দেওয়া পর্যন্ত বিচারক সঞ্চিতা সরকারের বদলি আটকেছেন, এমনকী রায় রুদ্ধদ্বার কক্ষে হবে না কি মুক্ত আদালতে, তা নিয়েও তাঁদের আবেদনের কথাই শোনা গেছে, নিহত ছাত্রীর পরিবারের কোনও কথা আমরা এই পর্বে শুনিনি, শুধু একটু অনুষ্ঠানে এক অভিযুক্তের ভাইকে মঞ্চে দেখে উষ্মায় মঞ্চ ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনাটি ছাড়া। কোন কোন ধর্ষকপ্রেমী মানুষের জন্য ধর্ষকদের এই মঞ্চ এত জোর পাচ্ছে? এমনকী সাম্প্রতিক অতীতে গণধর্ষণের অভিযোগের অন্যতম সাড়াজাগানো ঘটনা লাভপুরের সালিশি থেকে আদিবাসী তরুণীর নিগ্রহের ঘটনাতেও আদৌ ধর্ষণ হয়েছিল, না কি অভিযুক্ত তেরো জনকে ‘ফাঁসিয়ে’ দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অবিস্মরণীয় দ্রুততায় বিচার শেষ করে প্রত্যেককে কুড়ি বছর করে কারাদণ্ড দেওয়ার আগে-পরেও কোনও অনুরূপ মঞ্চ তৈরি হয়নি। কামদুনির ধর্ষকদের পরিবারের এই মঞ্চ এবং তাকে শাসক দলের সহায়তার নানা নজিরও কামদুনির মানুষদের, অসমসাহসী টুম্পা-মৌসুমী, তাঁদের পরিবার আর পরিজনদের আশঙ্কাকে মুছে দিতে পারছে না।
তত্ত্ব যা-ই বলুক না কেন, অভিজ্ঞতা বলে, মানবাধিকার কর্মীরা রাষ্ট্রের কোনও না কোনও স্তম্ভের পুলিশ হোক বা সেনাবাহিনী, তাদের করা কুকর্মগুলিকেই শুধু গুরুত্ব দেন, নিগৃহীতদের স্বার্থকে গৌণ করে দেখেন, সাক্ষীদের, নিগৃহীতদের পরিবার-পরিজনের সুরক্ষা, এ সবের জন্যে মৌখিক দাবির বাইরে কোনও বাস্তব লড়াই গড়ে তুলতে দেখা যায় না। যে ধর্ষক এক সহনাগরিককে যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করল এবং শুধু তা নয়, একটি পুরো অঞ্চলকে, আগামী বহু প্রজন্মকে সন্ত্রস্ত করে দিল, তাদের মানবাধিকারের কথা আমরা ভাবব কি? এই মানবাধিকার হরণ কোনও রাষ্ট্র করেনি, করেছে কিছু অন্য নাগরিক। প্রশাসনের কোনও না কোনও মদতে তারা বলীয়ান, তাদের মানবাধিকার সুরক্ষার নামে কোনও উচ্চারণ তাই শুধু অন্যায় নয়, আরও বহু মানুষের মানবাধিকার হরণ। কামদুনির ধর্ষণ কোনও বিকৃত কামের প্রয়োগ নয়, এটি কামদুনি গ্রামের সমস্ত মানুষকে জানানো যে, আমাদের ক্ষমতাই শেষ কথা। ধর্ষকদের আত্মীয়দের নিয়ে শাসক দলের সমর্থনে একটি মঞ্চ গড়া বিরলের থেকেও বিরল ঘটনা। এই ভয়ঙ্কর বৃত্ত— যা আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গকে গ্রাস করতে উদ্যত, এখনই কঠোর শাসনে বাধা দেওয়া প্রয়োজন।
পশ্চিমি মানবাধিকারের উত্তরাধিকার আমাদের ক্রমশ এক বিমূর্ত মানবাধিকারের ভাবনায় দাঁড় করিয়েছে। এতে সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ একদল শিক্ষিত সচ্ছল শহুরে মানুষ, যাঁদের জীবনযাপনে কোনও বিপন্নতা নেই। তাঁরা রাষ্ট্র নামক এক বিমূর্ত ধারণার সঙ্গে লড়াই করে ধার করা বিপন্নতার আঁচে তাঁদের বৌদ্ধিক চেতনা উষ্ণ রাখেন। সবার জন্য সমান মানবাধিকারের উপহারের এই পরম্পরায় জার্মানির কোলন সহ অন্যান্য স্থানে ২০১৬ সালের নববর্ষের রাতে দেড় হাজারের বেশি যৌননিগ্রহের অভিযোগ সামনে এসেছে। তাঁরা নতুন করে ভাবছেন, আমরাও ভাবি। কামদুনির মেয়েদের স্বস্তি দেবে এমন বিচার চাই, এমন প্রশাসন চাই। চাই এমন হিম্মত যার কল্যাণে কামদুনির ধর্ষকদের সহায়করা আর মাথা উঁচু করে ফুটবল খেলতে না পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy