জয়ী। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবীস ও রাজ্য বিজেপি সভাপতি রাওসাহেব দাণবে। মুম্বই। পিটিআই
ম হারাষ্ট্রে ১৬৪টি পুরসভার নির্বাচনী ফল ঘোষিত হয়েছে। রাজ্যে পুরনির্বাচন চলবে জানুয়ারি পর্যন্ত, দফায় দফায়। এটা ছিল প্রথম পর্ব। এই ফলাফল সংকেত দেয়, আধা-শহর ও গ্রামীণ এলাকায় বিজেপির সমর্থন আরও জোরদার হয়েছে। মরাঠাদের জন্য সংরক্ষণের দাবিতে রাজ্যে যে আন্দোলন চলছে, কিংবা ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, সেই অসন্তোষ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে বিরোধী শিবিরের কংগ্রেস ও এনসিপি। জানুয়ারিতে বৃহন্মুম্বই মহানগরপালিকার নির্বাচনেও এই পরিস্থিতির প্রভাব পড়বে বলে মনে হয়।
১৪৭টি পুর কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আয়োজিত সরাসরি নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছে ৫২টি আসন, শিবসেনা ২৩, কংগ্রেস ১৯, এনসিপি ১৬ এবং অন্যরা ২৮। কংগ্রেস-এনসিপি’র শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলিতে, বিশেষত পশ্চিম মহারাষ্ট্রে, ৩৫১০টি পুর কাউন্সিল আসনেও বিজেপি অগ্রবর্তী। দলগত অবস্থান হল: বিজেপি ৮৫১, শিবসেনা ৫১৪, এনসিপি ৬৩৮, কংগ্রেস ৬৪৩, এমএনএস ১৬, বিএসপি ৯, সিপিআইএম ১২, বিভিন্ন স্থানীয় জোট ৩৮৪, নির্দল ৩২৪ ও অন্যান্য ১১৯। ২০১১ সালের নির্বাচনে ১৪৭টি পুর কাউন্সিলের মধ্যে ১২৭টিতে বিজেপি কোনও পাত্তাই পায়নি, সব মিলিয়ে তার আসনসংখ্যা ছিল ২৯৮, কংগ্রেসের ৭৭১, এনসিপি ৯১৬ এবং শিবসেনা ২৬৪।
ভোটের ফল আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন, এ হল ‘বিজেপির দরিদ্র-মুখী এবং উন্নয়নী রাজনীতির জয়’। তিনি তৃণমূল স্তরে নির্বাচনী সংগঠনের কার ক্ষেত্রে দারুণ কাজ করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবীস এবং রাজ্য বিজেপির প্রধান রাওসাহেব দণবের প্রশংসা করেন। মোদীর বাহবা-টুইটের জবাবে ফড়নবীস লিখেছেন, ‘ধন্যবাদ স্যর! আপনি আমাদের জনসাধারণের মনে বিশ্বাস জাগিয়েছেন যে, দেশের রূপান্তর ঘটছে। এই জনাদেশ প্রমাণ করে, মহারাষ্ট্র আপনার স্বচ্ছতার অভিযানে শামিল।’ রাজ্যের দলীয় সদর কার্যালয়ে ঘরোয়া বিজয় উৎসবে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, এই নির্বাচন ছিল নোট বাতিলের বিষয়ে একটা গণভোটের শামিল এবং মানুষ জানিয়ে দিয়েছেন, এই সিদ্ধান্তে তাঁদের যত অসুবিধাই হোক, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর পিছনে আছেন, ‘এর নাম দেশপ্রেম’।
শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে নোট বাতিল সহ নানা বিষয়ে বিজেপির সমালোচনা করে আসছেন। রাজ্য সরকারে বিজেপির শরিক হয়েও শিবসেনা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু বিজেপি অবিচল, তারা জানে, যত গর্জায় তত বর্ষায় না। মুম্বইয়ের পুরভোটে সেনাকে ঠেকাতে বিজেপি রাজ ঠাকরের মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনাকে মদত দিচ্ছে, কখনও কখনও খোলাখুলি। মুম্বই পুরনিগমকে দেশের সবচেয়ে সম্পন্ন পুরসভা বলে মনে করা হয়, ২০১৬-১৭ সালে তার বাজেটের পরিমাণ ছিল ৩৭,০৫২ কোটা টাকা। এখন এটি চালায় বিজেপি-শিবসেনা জোট, কিন্তু ৭৫টি আসন নিয়ে শিবসেনাই প্রধান শরিক, বিজেপির হাতে ৩১ জন পুরপিতা। কুড়ি বছরের উপর শিবসেনা এই পুরসভায় আধিপত্য বজায় রেখে আসছে। মুম্বই পুর এলাকার ৫২টি ওয়ার্ডে মরাঠি মানুস-এর প্রাধান্য। তাঁরাই শিবসেনার সামাজিক ভিত্তি। বিজেপি চায়, এই সব অঞ্চলে এমএনএস-এর প্রতিপত্তি বাড়ুক, যাতে তারা ২০১৭-র ভোটে বড় শরিকের ভূমিকায় উঠে আসতে পারে। প্রথম পর্বের পুরভোটের ফলাফল বিজেপিকে উজ্জীবিত করেছে। শিবসেনা বিজেপিকে পছন্দ করে, কিন্তু তাদের সঙ্গে হাত না মিলিয়েও সেনার উপায় নেই।
পুরভোটের প্রথম পর্বের ফলাফল এটাও জানায় যে, কংগ্রেস এবং শরদ পওয়ারের এনসিপি তাদের সামাজিক ভিত্তি, অর্থাৎ মরাঠা-কুণবিদের মধ্যে সমর্থন হারাচ্ছে। শিক্ষায় ও সরকারি চাকরিতে এবং শিক্ষায় সংরক্ষণের দাবিতে মরাঠা ক্রান্তি মোর্চার আন্দোলন রাজ্য জুড়ে বিপুল জনসমর্থন পেয়েছে। প্রায় প্রতিটি জেলায় বিশাল সমাবেশ হয়েছে— জনবহুল কিন্তু শান্ত ও সুশৃঙ্খল। এর আগের কংগ্রেস-এনসিপি সরকার অর্ডিন্যান্স জারি করে মরাঠাদের সংরক্ষণ দিয়েছিল, কিন্তু হাইকোর্টে সেই অধ্যাদেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলা হয়, শুনানি এখনও চলছে। মামলা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া রাজ্য সরকারের আর কিছু করণীয় নেই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সুহাস পালসিকর এই প্রেক্ষিতেই একটি সংবাদপত্রে লিখেছেন যে, ফড়ণবীস সরকার আগ্নেয়গিরির উপরে বসে আছে। তাঁর মতে, মরাঠা ক্রান্তি মোর্চা মরাঠিদের মধ্যে একটা নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার কাজে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে।
মহারাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ হল মরাঠা-কুণবি গোষ্ঠীর। ১৯৬০ সালে এই রাজ্যের জন্মের সময় থেকে এঁরাই ক্ষমতাসীন। এঁরা প্রধানত কৃষিজীবী, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত এঁদের খুবই বিপাকে ফেলেছে। কৃষিপণ্যের ব্যাপারিদের অনেকে নগদ টাকার অভাবে কৃষকদের কাছে ফসল কিনতে পারেননি, ফলে কৃষিপণ্যের দাম সামগ্রিক ভাবে ৪০ শতাংশ পড়ে গেছে, বেশ কিছু কৃষিপণ্য বিপণন কমিটি (এপিএমসি) বন্ধ করতে হয়েছে। কৃষকরা হাইওয়েতে অবিক্রীত টমেটো ফেলে দিয়েছেন, এমনও ঘটেছে। রাজ্যের চিরাচরিত ক্ষমতার কেন্দ্রগুলির বেশির ভাগই এনসিপির নিয়ন্ত্রণে, যেমন এপিএমসি, চিনি উৎপাদকদের সমবায়, জেলা সমবায় ব্যাঙ্ক, সর্বোচ্চ স্তরের সমবায় ব্যাঙ্ক, জেলা পরিষদ। স্বভাবতই, পুরভোটে এনসিপির পরাজয় দলনেতা শরদ পওয়ারকে অবাক করে দিয়েছে। দৃশ্যত, শিবসেনা এবং বিরোধী দলগুলি নোট বাতিলের বিরুদ্ধে জমে ওঠা ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। কংগ্রেস ও এনসিপির নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে ঠেকেছে বলেই মনে হয়।
আপাতত রাজ্যের বহু শহরে একটা ব্যাপার দেখা যাবে— পুর কাউন্সিলের সদস্যদের সংখ্যায় যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ, কাউন্সিলের সরাসরি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তার বিরোধী শিবিরের। তিনি হয়তো এক দিকে যেতে চাইবেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য অন্য দিকে। এর ফলে পুরসভার কাজের অসুবিধা হবে, শহরের পুর পরিষেবা ব্যাহত হবে, পুরনির্বাচনের মূল উদ্দেশ্যটাই বানচাল হবে। আশঙ্কা হয় যে, এই শহরগুলির পুর প্রশাসন সংকীর্ণ স্থানীয় রাজনীতির শিকার হতে চলেছে। একটা যথার্থ নাগরিক সমাজ এবং স্থানীয় স্বশাসন খুঁজে পেতে এখনও অনেক পথ বাকি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy