ই তিহাস হইতে শিক্ষা না লইলে বিপদে পড়িতে হয়। কিন্তু ক্ষুদ্র রাজনীতির স্বার্থে ইতিহাসকে ব্যবহার করিতে চাহিলে ইতিহাস যে শিক্ষা দেয়, তাহা আরও বড় বিপদ ঘটাইতে পারে। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী ঠিক কোন রাজনৈতিক অঙ্ক কষিয়া টিপু সুলতানের জন্মজয়ন্তী পালনে প্রবৃত্ত হইয়াছেন তাহা তিনিই জানেন, কিন্তু শ্রীযুক্ত সিদ্দারামাইয়া এতদ্দ্বারা সম্পূর্ণ অহেতুক অশান্তির বীজ বপন করিয়াছেন। সাম্প্রদায়িকতার কারবারিরা তাহার সুযোগ লইবে, তাহা অবধারিত ছিল। নাট্যকার ও অভিনেতা গিরিশ কারনাডের অসতর্ক উক্তির প্রতিক্রিয়ায় তর্ক না করিয়া তাঁহাকে খুনের হুমকি দেওয়াও নরেন্দ্র মোদী-কথিত ‘বুদ্ধ ও গাঁধীর দেশ’-এ ইদানীং অপ্রত্যাশিত নয়। এই অন্যায় ও জঙ্গি অসহিষ্ণুতার কঠোরতম শাস্তি জরুরি। কিন্তু তাহাতে সিদ্দারামাইয়ার আদি পাপের লাঘব হয় না। তিনি একটি রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক। ইতিহাস খুঁড়িয়া সংঘাতের আগুন জ্বালাইবার সমিধ সরবরাহ করা তাঁহার কর্তব্যতালিকায় পড়ে না।
প্রশ্ন উঠিতে পারে: টিপু সুলতানে আপত্তি কীসের? অষ্টাদশ শতকের শেষে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সহিত প্রবল যুদ্ধ করিয়া পরাজিত ও নিহত এই মহীশূর-অধিপতির বীরত্বের কাহিনি পাঠ করিয়া এ দেশে শিশুরা বড় হইয়া আসিতেছে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিকরা অনেকে সেই কাহিনি হইতে প্রেরণা সংগ্রহ করিয়াছেন, শ্রীরঙ্গপত্তনের লড়াইকে কেহ কেহ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম অবধি বলিয়াছেন। তাঁহার স্মরণ-উত্সব কেন সাম্প্রদায়িক বিরোধের উপলক্ষ হইবে? তাঁহার ধর্মীয় পরিচিতি কেন আদৌ প্রাসঙ্গিক হইবে? এখানেই ইতিহাসের ফাঁদ। টিপু সুলতান বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করিয়াছিলেন, সত্য। কিন্তু তিনি ধর্মে মুসলমান, তাহাও অসত্য নহে। যেমন অসত্য নহে মুঘল সাম্রাজ্যের ধর্মীয় মাত্রাটি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতে মুসলিম রাজত্বের অবসান এবং ব্রিটিশ রাজত্বের সূচনা— এই ধারণাটির বিরুদ্ধে প্রবল যুক্তি থাকিতে পারে, কিন্তু তাহাতে ধারণাটি উড়িয়া যায় না। এ কথাও অস্বীকার করা চলে না যে, বিভিন্ন মুঘল বাদশা সহ এ দেশের অনেক ইসলাম ধর্মাবলম্বী অধিপতির মতোই টিপু সুলতানের আচরণেও ভিন্নধর্মের মানুষ ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অসহিষ্ণুতা এবং বিদ্বেষের নিদর্শন ইতিহাসে আছে। মালাবার বা কুর্গ অঞ্চলে তাঁহার বাহিনী বহু মন্দির লুণ্ঠন করিয়াছে, অধিবাসীদের নিপীড়ন করিয়াছে। ‘সাজানো ঘটনা’ নহে, ইতি হ আস।
প্রতিপ্রশ্ন উঠিবে: লুণ্ঠন তো সে কালে অন্যের এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের একটি বহুলপ্রচলিত প্রকরণ! এবং, টিপু সুলতান নিজ রাজত্বে হিন্দুধর্মের প্রতিষ্ঠানে অর্থসাহায্য করিয়াছেন, ইতিহাস তো তাহাও বলে! এ কালের সাম্প্রদায়িকতার চশমা পরিয়া আঠারো শতকের ভারতকে দেখা কি ভুল এবং বিপজ্জনক নয়? অনেক পরিচিতির মধ্যে কোনও একটিকে একমাত্র পরিচিতি বলিয়া গণ্য করিলে যে হিংসার উদ্ভব হয়, অমর্ত্য সেন (আইডেনটিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স) তাহার স্বরূপ বিশ্লেষণ করিয়াছেন। টিপু সুলতানকে (শুধুমাত্র) মুসলমান হিসাবে দেখিলে সেই হিংসাই অনুশীলন করা হয় না কি? গুরুতর প্রশ্ন, অবশ্যই। বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে আলোচনা করিবেন, জনসমাজ তাহাতে যোগ দিবে, নূতন প্রশ্ন তুলিবে, তর্ক চলিবে, ক্রমাগত ইতিহাসের নূতন বিচার হইবে, নূতন অর্থ খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে, ইহাই একটি সচল, সজীব সভ্যতা ও সংস্কৃতির লক্ষণ। যে অসহিষ্ণুতা সমকালীন ভারতের চরিত্রলক্ষণে পরিণত হইতেছে, তাহার মোকাবিলাতেও জনপরিসরে মুক্ত বিতর্ক অত্যাবশ্যক। কিন্তু সেই পরিসরে দলীয় রাজনীতি প্রবেশ করিলেই বিপদ। আর, সরকার যদি ইতিহাস মন্থনে প্রবৃত্ত হয়, গরল উঠিবেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy