Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪

এত নির্দল প্রার্থী কেন

গণতন্ত্রের এই অসুস্থ অভ্যাস বন্ধ করতে হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পদ্ধতিটি বোঝা দরকার। নির্বাচনে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে গেলে সাধারণ শর্ত ছাড়াও দু’টি জিনিস লাগে: কিছু টাকার জামানত, ও কিছু ভোটারের সই।

কৌশিক ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

মোদাকুরিচি বিধানসভা কেন্দ্র, তামিলনাড়ু, ১৯৯৬। হাজারের উপর প্রার্থী, তাই বাধ্য হয়ে ব্যালট পেপার নয়, ব্যালট বই ছাপাল নির্বাচন কমিশন! একটি কেন্দ্রে একশোর বেশি প্রার্থী, ভারতে এ রকম ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েক বার। আর পঞ্চাশের উপর প্রার্থী অন্তত আশি বার। প্রার্থীদের বিরাট অংশই হল নির্দল।

এত নির্দল প্রার্থী কেন? কারণ তিনটি। দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলেই বহু গোষ্ঠী। কোনও গোষ্ঠীর নেতা মনোনয়ন পেলে পার্টির অন্য গোষ্ঠীরা তাঁর বিরুদ্ধে নির্দল প্রার্থী খাড়া করে। দ্বিতীয় কারণ, নির্দল প্রার্থীকে শিখণ্ডী বানিয়ে তাঁর মাধ্যমে বড় দলগুলি নিজেদের প্রার্থীর জন্য টাকাপয়সা খরচ করে। তৃতীয় কারণটি বেশ মজার। ধরুন, আপনি কোনও নির্বাচনে ক-দলের প্রার্থী। নিজের ভোট না বাড়িয়েও আপনি অনায়াসে নির্বাচনে জিততে পারেন মূল প্রতিদ্বন্দ্বী খ-এর ভোট কমিয়ে। আপনি তাই খ-এর বিরুদ্ধে এমন নির্দল প্রার্থী খাড়া করে দিলেন যাঁর জাত, ধর্ম, ভাষা, নাম ইত্যাদির অন্তত একটি ঠিক খ-এর মতো। মজা এই যে আপনি যা করতে পারেন খ-বাবুও সেই এক কাজ করতে সক্ষম। এর মানে, নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী বেড়ে গেল। বাংলায় এই নির্দল প্রার্থীদের একটি সুন্দর নাম রয়েছে: গোঁজ প্রার্থী। গোঁজ প্রার্থী খাড়া করার অবশ্য খরচ রয়েছে। এঁদের দেখা তখনই মেলে যখন জেতা-হারা নিয়ে বড় দলের প্রার্থীরা নিশ্চিত হন না।

গণতন্ত্রের এই অসুস্থ অভ্যাস বন্ধ করতে হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পদ্ধতিটি বোঝা দরকার। নির্বাচনে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে গেলে সাধারণ শর্ত ছাড়াও দু’টি জিনিস লাগে: কিছু টাকার জামানত, ও কিছু ভোটারের সই। বর্তমানে সাধারণ প্রার্থীদের বেলা জামানত পঁচিশ হাজার টাকা, তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের বেলা সাড়ে বারো হাজার। সঙ্গে প্রার্থীদের দরকার মাত্র এক জন ভোটারের সই, কিন্তু ছোট দল এবং নির্দল প্রার্থীদের দরকার দশ জনের।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

নির্দল প্রার্থীর সংখ্যা রুখতে জামানত বাড়ানো খুব একটা কাজে আসে না। নির্বাচন মানেই কোটি কোটি টাকার খেলা, পঁচিশ হাজার টাকার জামানত সেখানে খুচরো পয়সা মাত্র। তা ছাড়া, মূল্যবৃদ্ধির ফলে জামানতের আসল মূল্য ক্রমে কমে আসে। তাই ঘন ঘন না পাল্টালে এর দ্বারা প্রার্থিসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। আদর্শগত দিক থেকেও, জামানত বাড়ানো মানে নবাগত, গরিবদের প্রার্থী হতে বাধার সৃষ্টি করা। সইয়ের সংখ্যা পাল্টিয়ে কিন্তু প্রার্থিসংখ্যার উপর অনেক বেশি প্রভাব ফেলা সম্ভব। একশো ভোটারের সই জোগাড় করাটা পরিশ্রমের। সংখ্যাটি পাঁচশো বা হাজার হলে তো কথাই নেই।

সইয়ের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে নির্দল এবং ছোট রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ আটকে দেওয়াকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে আমেরিকা। কথা হল, নির্দল বা ছোট দলের প্রার্থী মাত্রেই খারাপ নন। যাঁরা যোগ্য তাঁদের প্রার্থী হওয়ার পথ বন্ধ করাটা কি দেশেরই ক্ষতি নয়? এ পথ বন্ধ করলে বড় দলগুলির সুবিধে। আমেরিকার অনেক চিন্তাবিদ তাই এই নিয়মগুলির মধ্যে রিপাবলিকান আর ডেমোক্র্যাটদের হাত মিলিয়ে পরিবর্তনকামী ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব বন্ধ করার চক্রান্তের গন্ধ পান। তাঁদের মতে, এই নিয়মগুলির জন্য সে দেশের মানুষ গতানুগতিকতায় হাঁপিয়ে ওঠেন, পরিবর্তন আনতে চাইলেও তা করে উঠতে পারেন না। ফলে এঁরা রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েন আর তাতে সুবিধা হয় ক্ষমতা যাঁদের হাতে আছে তাঁদের। বহুমুখী নির্বাচন, এর সমস্ত জটিলতা সত্ত্বেও এক ধরনের রাজনৈতিক সুস্থতার লক্ষণ। যত মত তত পথ: বহু পথের তর্কে সব প্রার্থীই চেষ্টা করেন নিজের যুক্তি ধারালো করার, পাল্লা দেন মানুষের কাছে আসার। অন্য দিকে, বহু প্রার্থী নির্বাচনের খরচ ও সরকার গঠনের জটিলতা বাড়িয়ে তোলেন। ভারতের মতো গরিব দেশের পক্ষে এই সমস্যাগুলি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।

একটা পথ ভাবা যায়। সইয়ের সংখ্যা বাড়াতে পারি শুধুমাত্র বিশেষ কিছু কেন্দ্রে, বিশেষ অবস্থায়। ধরুন, প্রার্থীর সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গিয়েছে। এমন অবস্থায় নির্বাচন কমিশন যদি নির্দল প্রার্থীদের জন্য সইয়ের সংখ্যা অনেকটা বাড়িয়ে দেয় এবং দরকারে তার জন্য ওই কেন্দ্রে ভোট আরও এক সপ্তাহ পিছিয়ে দেয়, তবে গোঁজ প্রার্থীরা অনেকটা জব্দ হন। অবশ্য নির্বাচন কমিশনকে এমন ক্ষমতা দিতে গেলে জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের বদল চাই।

সামনেই লোকসভা নির্বাচন। মনে রাখতে হবে, জামানতের পরিমাণ দশ থেকে বাড়িয়ে পঁচিশ হাজার করা হয় ২০১০ সালে। গত ন’বছরে মূল্যবৃদ্ধির ফলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রকৃত খরচ ২০১০ সালের তুলনায় এখন কম। দেখা যায়, দেশে কোনও বড় দল বা জোটের ভাঙনের ফলে বহুমুখী প্রবণতা বাড়লে এবং সরকার গঠনের অনিশ্চয়তা বাড়লে নির্বাচনে নির্দলদের সংখ্যাও বাড়ে। অতীতে বহু বার, বিশেষত ১৯৯৬ সালের রাজনৈতিক ডামাডোলে আমরা দেখেছি। এ বারের নির্বাচনেও কি গোঁজ নির্দলদের দেখা যাবে? নির্বাচন কমিশন তৈরি তো?

আইআইএম (লখনউ)-এ বিজ়নেস এনভায়রনমেন্ট-এর শিক্ষক

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE