Advertisement
০৪ মে ২০২৪

শিক্ষাব্যবস্থা ও মৌলবাদ

ক্লাস শেষ হওয়ার কিছু আগে স্যর আমাকে ডাকলেন এবং খাতা নিয়ে তাঁর কাছে হাজির হতে হুকুম করলেন।

গৌরব গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে আমি ক্লাস সেভেনে পড়তাম। দক্ষিণ কলকাতার সরকারি ইস্কুলের ছাত্র ছিলাম। আমাদের অঙ্কের ক্লাস চলছিল। উদয়বাবু অঙ্ক ক্লাস নিচ্ছিলেন। ভগ্নাংশ শেখানো হচ্ছিল। পাঠ্যপুস্তকে ওই অঙ্কের প্রস্তাবিত পদ্ধতি দেওয়া ছিল, স্যর সে ভাবে বুঝিয়েও দিচ্ছিলেন। তো, যে কোনও কারণে প্রস্তাবিত পদ্ধতির বদলে কিছু ভিন্ন এবং স্বকীয় উপায়ে উক্ত অঙ্কের সমাধান করেছি। কিছুটা উৎসাহ নিয়ে স্যরকে দেখিয়েছি। উনি খাতাটা এক ঝলক দেখেই আমার দিকে সামান্য দৃকপাত করে বললেন ‘গাধা’। এবং খাতাখানা ছুড়ে দিলেন। আমিও ক্লাসের অতিসাধারণ ছাত্র। কাজেই নিজেকে নির্বোধ ভাবতে কোনও সমস্যা হয়নি।

ক্লাস শেষ হওয়ার কিছু আগে স্যর আমাকে ডাকলেন এবং খাতা নিয়ে তাঁর কাছে হাজির হতে হুকুম করলেন। তো বাধ্য ছাত্রের মতো হাজির হলাম। এ বার অঙ্কটা খুঁটিয়ে দেখলেন। অবাক হয়ে বললেন, উত্তর তো ঠিকই আছে। পদ্ধতি আলাদা হল কী ভাবে? এ বার স্বগোতক্তি, “গাধাটার মাথায় বেশ বুদ্ধি আছে”।

বর্তমানে পদার্থবিদ্যার গবেষণারত ছাত্র এবং কলেজে অতিথি শিক্ষক হিসাবে কর্মরত। পেশাগত প্রয়োজনে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে পরিচিত। বর্তমানের পাঠ্যক্রমানুসারে কোয়ান্টাম মেকানিক্স, আপেক্ষিকতাবাদ, কণা পদার্থবিদ্যা ইত্যাদি অতি উচ্চাঙ্গের পদার্থবিজ্ঞান দ্বাদশ শ্রেণিতে ছাত্ররা পড়ছে। এ তো কেবল পদার্থবিদ্যা, বাকি অন্য বিজ্ঞান বিষয়ে অনুরূপ পাঠ্যক্রম চালু হয়ে গিয়েছে।

বিজ্ঞানের দর্শনে প্রাথমিক শর্ত হল, যে কোনও প্রস্তাবকে অন্ধ ভাবে স্বীকার না করে তাকে প্রশ্ন করা! বিজ্ঞান সে ভাবেই নতুন দিগন্তে জ্ঞানের উন্মেষ ঘটিয়েছে। অথচ বর্তমানের পাঠ্যক্রম ছাত্রদের পদার্থবিজ্ঞান বিষয়কে কিছু গাণিতিক সূত্রের সমষ্টিতে পরিণত করেছে। কারণ, অতি উচ্চাঙ্গের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বীয় জ্ঞানকে আত্তীকৃত করার উপযুক্ত পরিণতি হয়তো কোনও উচ্চ মাধ্যমিক পাঠরত ছাত্রেরই সঠিক অর্থে নেই। এই পরিস্থিতিতে, শিক্ষাব্যবস্থা ছাত্রছাত্রীদের উপর দ্বিমুখী প্রভাব ফেলছে। এক দল ছাত্রছাত্রী যারা বিষয়ের গভীরে গিয়ে পড়াশুনায় স্বকীয়তার ছাপ রাখতে চায়, তাদের কাছে বিজ্ঞান প্রহেলিকাময় ও দুর্বোধ্য ঠেকছে, কারণ উক্ত বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে পরীক্ষায় পাশ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে। অপর দিকে, এক দল ছাত্র যারা উপযুক্ত নম্বর পেয়ে পাশ করতে চায় তারা প্রায় সমস্ত সূত্রের গাণিতিক রূপের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তার তত্ত্বগত গুরুত্বকে অস্বীকার করছে। ফলত, উপযুক্ত বিজ্ঞান গবেষক বা বিজ্ঞানকর্মীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। বিজ্ঞান শিক্ষাকে স্রেফ উন্নত ভবিষ্যৎ এর সোপান রূপে গণ্য করছে ছাত্রছাত্রীরা। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, পরীক্ষাপত্র মূল্যায়নকালে নির্দিষ্ট ফরমান জারি হচ্ছে। যে ছাত্রী বা ছাত্র ওই ফরমান অনুযায়ী উত্তর লিখবে সে উপযুক্ত নম্বর পাবে।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে, কেন বিজ্ঞান শিক্ষায়, তথা যে কোনও শিক্ষার ক্ষেত্রে এত বিধিনিষেধ! বর্তমান নীতি প্রণেতারা কেনই বা শিক্ষাকে এত আমলাতান্ত্রিকতায় ঠেলে দিচ্ছেন?

যে আশঙ্কা উঁকি দেয়, তা হল স্বাধীন ও সৃষ্টিশীল চিন্তার যে অবকাশ জিজ্ঞাসু মনে স্বাভাবিক ভাবে আবির্ভূত হয় তাকে প্রথার বেড়াজালে বেঁধে ফেলার এ এক ক্লিনিকাল প্রচেষ্টা। আজ থেকে বিশ বছর আগে, এই প্রচেষ্টা সামাজিকতায় কিছুটা প্রচ্ছন্ন আকারে ছিল। কিন্তু আজ এই প্রচেষ্টা সামাজিক ভাবে সম্পূর্ণ স্বীকৃতি লাভ করেছে। সর্বোপরি পরীক্ষা ব্যবস্থা আদতে ছাত্রছাত্রীদের ‘আজ্ঞাবহ দাস’-এ পরিণত করেছে। মোটামুটি যা পরিস্থিতি, ‘ভাল ছাত্র বা ছাত্রী’ হিসাবে বর্তমান ব্যবস্থা তাকেই স্বীকৃতি দেবে যে এই ব্যবস্থাকে প্রশ্ন বিনে, সবচেয়ে বাধ্য ভাবে মেনে নেবে। চিন্তার জগতে মৌলবাদ প্রায়শই ইস্কুল থেকে দৃঢ় ভাবে আরোপিত হচ্ছে। শিক্ষার দর্শনগত ভিত্তিকে ভ্রান্তি-অভিমুখী করে দেওয়া বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম গভীর সঙ্কট এবং চক্রান্ত। সব মিলিয়ে এক দল আজ্ঞাবাহক বা চাটুকার শ্রেণির বিস্তার ঘটেছে, যারা চলতি ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি রূপে অবতীর্ণ। অন্য দিকে, উপযুক্ত মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিত্বরা পরদেশি হচ্ছেন। এরও বাইরে যাঁরা মেধাবী অথচ সুযোগের অভাব বা পরিস্থিতির শিকার হয়ে জ্ঞানের উচ্চতম স্থান অর্জন করতে পারলেন না তাঁদের কাছে হতাশাই প্রায় একমাত্র ভবিতব্য। সামগ্রিক ভাবে জাতি হিসাবে আমরা ক্রমান্বয়ে খর্বতার নতুন মাত্রা স্থির করছি।

পুনশ্চ: ভারতে শিশুদের মধ্যে সামান্য অংশই শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গীভূত। তা ব্যতিরেক যে বিপুল সংখ্যক শিশু ন্যূনতম অক্ষরজ্ঞানও লাভ করল না, তার দায় আমাদেরও, যারা ‘শিক্ষিত’ হতে পারলাম। কিন্তু ‘শিক্ষিত’ হতে পারলে তবেই তো দায় স্বীকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Restriction
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE