পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করিয়াও পাকিস্তানের জন্মকেই প্রবল অযৌক্তিক বলিতেছেন, এমন গবেষকও পাকিস্তানে আছেন। অথচ ভারত সম্প্রতি এমন জায়গায় পৌঁছাইয়াছে যেখানে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহকে ‘মহাকালের অবতার’ অর্থাৎ ‘প্রশ্নাতীত’ বলিয়া না মানিলেও খুনের হুমকি পাইতে হয়। পাকিস্তানের অপেক্ষাও বড় পাকিস্তান হইয়া উঠিবার খেলায় অবশেষে ভারতকে জয়ী বলা চলে। ইহা কেবল সমালোচক সেকুলার ভারতীয়ের কূটকচালি নহে, প্রথম সারির বিদেশি পত্রপত্রিকাও এই মুহূর্তে ভারতের অসহিষ্ণুতার শীর্ষস্থান অধিকার বিষয়ে মন্তব্য করিতেছে। অগ্রগণ্য ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ সম্প্রতি কয়েক বার মোদী ও শাহ, দুই ‘মহাকালের অবতার’ বিষয়ে কঠোর সমালোচনা করায় আপাতত তাঁহার মেলবাক্স ভরিয়া হুমকি-বার্তা: কিছু দিনের মধ্যেই মহাকালের অভিশাপ তোমার উপর বর্ষিত হইবে, প্রস্তুত হও। অভিশাপ যদি কেহ হাতে-কলমে ‘বর্ষণ’ করিতে চায়, এই ভারতে যে তাহা কঠিন কাজ নয়, গোবিন্দ পানেসর কিংবা নরেন্দ্র দাভোলকর কিংবা এম এম কালবুর্গিদের ভয়ঙ্কর নিধন স্মরণ করিলেই বোঝা যায়। প্রবল হিংসার কালসমুদ্র যে ভাবে ফুঁসিয়া উঠিতেছে, তাহাতে এখন হিন্দুত্ববিরোধিতা বা ধর্মবিরোধিতা অবধি যাইবার দরকার নাই, সরকারবিরোধিতা কিংবা অপরাধবিরোধিতা করিলেও হিন্দুত্ব-গুন্ডাদের রোষানলে পড়িতে হয়। কর্তৃত্ববাদ, ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি বইয়ে-পড়া তত্ত্ব বা ইতিহাস এখন চোখের সামনে সংঘটিত হইতেছে: দেখা যাইতেছে কাহাকে বলে অসহিষ্ণু উগ্র জাতিবিদ্বেষ, কাহাকে বলে টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্র— যাহার বিরুদ্ধে কথা কেন, নিঃশ্বাসও ফেলা যায় না।
পশ্চিমবঙ্গকে বাহবা, এই রাজ্যও অতি দ্রুত সর্বভারতীয় অসহিষ্ণুতার ধ্বজাটি গ্রহণ করিতেছে। ধ্বজাটির বার্তা: অন্য কাহারও কথা মানিব না তো বটেই, অন্য কেহ যাহাতে কথা উচ্চারণও করিতে না পারে, তাহার ব্যবস্থা পুরা দমে করিব। সেই কারণেই শ্রীজাতের বিরুদ্ধে উন্মত্ত হিংসাত্মক বার্তার অঝোর বর্ষণ। সেই কারণেই মন্দাক্রান্তা সেন-এর বিরুদ্ধে গণধর্ষণের বার্তা, ঠিক যেমন ঘটিয়াছে দিল্লির গুরমেহর কৌরের ক্ষেত্রে। মহিলা হইলে ধর্ষণ, পুরুষ হইলে নির্যাতন: হুমকির ব্যাকরণটি তো জলবৎ। সঙ্গীতজ্ঞ আমজাদ আলি খান গভীর দুঃখের সঙ্গে বলিয়াছেন, চোখের সামনে গোটা তরুণ প্রজন্ম সম্পূর্ণ অ-মানবিক হইয়া গেল, অন্য মানুষের প্রতি ন্যূনতম মানবিক সংবেদনও তাহারা বোধ করে না। তাঁহার প্রশ্ন দেশের সব শুভবোধসম্পন্নের প্রশ্ন: কী শিখাইল দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যাহাতে ছেলেমেয়েরা মানুষকে মানুষ বলিয়া ভাবিবার শিক্ষাও পাইল না?
সমস্যা হইল, অসহিষ্ণুতা যেখানে দুর্দম ও দুর্দান্ত পেশিশক্তির পৃষ্ঠপোষকতার অধিকারী, তাহার উল্টা দিকে যুক্তি বুদ্ধি ধৈর্য সংবেদন সবই নেহাত নিরামিষ, অকেজো। পাল্টা শক্তি প্রয়োগ ব্যতীত এই সংকট হইতে বাহির হইবার উপায় নাই। যাহারা হুমকি দিতেছেন, তাহাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রশাসনের কর্তব্য। প্রশাসন সেই কর্তব্য না করিয়া অগুনতি অন্যায়কারীদের সামলাইবার কাজটি নাগরিকের শুভবোধ জাগরণের উপর ছাড়িয়া দিলে কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকগুলিকে জীবিত ও সুস্থ অবস্থায় আর দেখাই যাইবে না। মনে রাখিতে হইবে, সহিষ্ণু গোষ্ঠী অকথ্য দুরাচারকেও জায়গা ছাড়িয়া দেন, আর অসহিষ্ণু গোষ্ঠী একটি শব্দ উচ্চারণের দোষেই গণধর্ষণ লেলাইয়া দিতে চাহেন। এই অসম যুদ্ধে উদার মনোভাবাপন্ন সমাজকে রক্ষা করার দায় প্রতিটি নাগরিকের। প্রতি মুহূর্তে তাঁহাদের লড়িতে হইবে এই বলিয়া যে, মতামতের মান্যতা বা স্বীকৃতি পরের কথা। প্রথম কথা: যাহার যাহা মত, সেটুকু প্রকাশ করিবার অধিকার নিশ্চিত করা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy