Advertisement
০৩ মে ২০২৪
এ বার পুজোয় পুরনো আনন্দবাজারের পাতা থেকে স্বর্ণসন্ধান

ফুর্তিরূপেণ সংস্থিতা

নিদেন পক্ষে মোমবাতির ব্যবস্থা প্রত্যেকেরই বুকের মধ্যে। পুজোয় যেমন ক’টা দিন লোডশেডিং দেন না সিইএসসি-র ভগবান, তেমনই হৃদয়ের লোডশেডিংটাও অনেকাংশে বন্ধ থাকে দুর্গামায়ের কৃপায়।

নবনীতা দেব সেন
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:০০
Share: Save:

পুজো এসে গেল। তাই বলে কি মন ভাল? অফিসে সে দিন এক ভদ্রলোকের মুখখানা দেখে বললুম, ‘কী মশাই, মুখখানা অমন দেখাচ্ছে কেন? আপনার হল কী?’ ভদ্রলোক বিমর্ষ চোখ তুলে বললেন: ‘মেন্টাল লোডশেডিং দিদি।’ সত্যিই তো? এই আশ্চর্য কথাটা তো সবার বেলায়ই প্রযোজ্য? কি ছোট, কি বড়।

মেন্টাল লোডশেডিং ঘটলে নানা উপায়ে আলো জ্বালানো যায়। কারও আছে ইনভার্টার, কারও জেনারেটর। নিদেন পক্ষে মোমবাতির ব্যবস্থা প্রত্যেকেরই বুকের মধ্যে। পুজোয় যেমন ক’টা দিন লোডশেডিং দেন না সিইএসসি-র ভগবান, তেমনই হৃদয়ের লোডশেডিংটাও অনেকাংশে বন্ধ থাকে দুর্গামায়ের কৃপায়।

মন ভাল করে দেওয়ার ওষুধ জানেন মা দুর্গা। নাকি সেটা অসুরের গুণে? আজকাল যুগটা হয়েছে নিপীড়িত নিম্নকোটির—ডাউনট্রড্ন সাব- অলটার্নদের যুগ, আর এই দুর্গাপ্রতিমার মধ্যে সত্যি সত্যি একটা নিষ্ঠুর উচ্চ-নীচ কাণ্ডকারখানা রয়েছে বইকি। স্পষ্টাস্পষ্টি দেখতে পাচ্ছি একটা শ্রেণি-বর্ণ-বিভেদের বিশ্রী অত্যাচার। তিনটে চোখ দশখানা হাত সালংকারা দেবীমূর্তি মাত্র দুই হাতওয়ালা বাঘের চামড়া-পরা এক বেচারা গরিব দানবকে শায়েস্তা করছেন তাঁর পদতলে। দশ হাত মানেই তাঁর বলভরসা অনেক বেশি, গা-ভর্তি গয়না, তায় জাতে তিনি দেবতা, তাঁর মরণ নেই। বেচারা দানবের দুটো হাত মানেই ১/৫ অংশ দুর্বল সে, তায় নশ্বর, এবং জাতে দানব, প্রায় অচ্ছুত। নিঃসন্দেহেই নিম্নবর্গ। শুধু কি তাই? এতে রেসিজ্ম-এর গন্ধ নেই? মা দুর্গার সোনার বর্ণ, স্পষ্টতই ককেশীয় রক্তে গড়া। অসুরটি ঘোর কৃষ্ণ, নাক থ্যাবড়া, আর চুলগুলো কী রুক্ষু কোঁকড়া! সে যদি নিগ্রয়েড না হয় তো কী বলেছি! অসুর বেচারিই হচ্ছে এ দেশের স্থানীয় বাসিন্দা (ইন্ডিজিনাস নিগ্রয়েড আ্যাবরিজিনি?) নিরীহ আদিবাসী নোম্যাডিক জাতের মানুষ, ঘুরে ঘুরে মহিষ চরিয়ে খায়। তাকে এই বিদেশিনি ককেশীয় অ্যামাজনীয় (তাঁরা গ্রিসের বাসিন্দা ছিলেন না?) নারীসেনা এসে— দশ হাতওলা দেবীটি তো এক জন নারী নন, এক দঙ্গল নারী— একটা সম্পূর্ণ নারী সেনাবাহিনীর প্রতীক নির্ঘাত, বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে লড়াই করে খতম করে দিল! রুজি-রোজগারের মহিষ-টহিষ সবসুদ্ধু শেষ! আর সিংহটা? ও কিছু না। যে কোনও সার্কাসেই দেখবেন লায়ন-টেমার নারী। উনিশ শতকের কলকাতায় ডক্টর বোসের সার্কাসেও বঙ্গনারী সুশীলা সুন্দরী ছিলেন লায়ন-টেমার। জলজ্যান্ত জয় অ্যাডামসন তো রয়েইছেন। বাঘসিংগি পোষ মানানো মেয়েদের কাছে কোনো ব্যাপারই নয়। ক্লিওপেট্রার প্রাইভেট চিতাবাঘের মতো এই অ্যামাজন নারীসেনার সঙ্গে পোষা সিংহটিংহ তো থাকতেই পারত। কাজটা তো সোজা নয়। একটা গোটা নিম্নবর্গীয় সভ্যতাকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে হবে তো? কিছু আদিম আরণ্যক পাশবিকতার স্পর্শ চাই না? তখন তো আর আমাদের সভ্যভব্য এইচ-বোমা ছিল না?

তবে হ্যাঁ, যে যাই বলুন, ফেমিনিজ্ম-এর দিক থেকে দেখলে, দুর্গার পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু ঝাঁ-চকচকে চমৎকার নারীটি। কী সুন্দর হাসতে হাসতে প্রায় অন্যমনস্ক ভাবেই পুরুষটিকে হেলায় পরাজিত করছেন। দেবী দুর্গার মধ্যে একটা অনায়াসপটুত্ব আছে। একটা অনায়াস হিংস্রতাও আছে, যেটা থাকা নারীদের পক্ষে অত্যাবশ্যক, কিন্তু প্রায়ই থাকে না।

মা কালীর ব্যাপারটা অবিশ্যি আরও চমৎকার। দারুণ কন্টেমপোরারি, ক্লিন থার্ড ওয়ার্ল্ড ভিউজ দিচ্ছে পুরো কালীপ্রতিমার ব্যাপারটাই। কত ধরনের সংখ্যালঘুদের সামাজিক সমস্যার মোকাবিলা করা হয়েছে ওই একটিমাত্র তীব্র প্রতীকের মাধ্যমে। রেসিজ্মই বলুন, সেক্সিজ্মই বলুন, এমনকি সাব-অলটার্ন স্টাডিজের পক্ষেও দারুণ লাগসই ওই কালী ঠাকুর। ভেবে দেখুন, সেখানে সাব-অলটার্নের ভূমিকাটি কিন্তু পাল্টে গেছে। দুর্গার ঠিক বিপরীত। ফেমিনিজ্‌মের দিক থেকে যদিও অপরিবর্তিত দৃষ্টিকোণ। অমন দশাসই রজতগিরিনিভ পুরুষটি অচৈতন্য হয়ে পপাত ধরণীতলে— তাঁর চিৎপটাং বিপুল বক্ষদেশে কুচকুচে কালো দুটি পায়ে রক্তঅলক্তক মেখে রুখে দাঁড়িয়ে ক্রোধবিস্ফারিত ত্রিনয়নে, উদ্ধত অনাবৃত নগ্নতায় উদ্যত উন্মুক্ত রক্তাক্ত খড়্গ আস্ফালন করছেন এলোকেশী কৃষ্ণবর্মা যুবতীটি— আঃ, চোখ-জুড়োনো দৃশ্য!

অসুরের মতোই, মা কালীকেও দেখবামাত্র নিম্নবর্গীয় বলে দিব্যি চেনা যায়। হতদরিদ্র, পরনে এক টুকরো লজ্জাবস্ত্রও জোটেনি। আদিবাসী মেয়ে, তাতে সন্দেহ নেই, ওই চমৎকার চকচকে কালো রং-এর শ্রী, ওই ফিগার, এমন চুলের রাশি—আর ওই সাহস— ও আদিবাসী না হয়ে যায় না। সবচেয়ে বড় কথা গলার মুণ্ডমালা। প্র্যাকটিসিং ক্যানিবাল্স ভিন্ন ওই বস্তু সংগ্রহ করা দুঃসাধ্য। এত কাটা মুন্ডু জমিয়ে জমিয়ে মালা গাঁথা— এই দুরূহ কীর্তি একমাত্র প্রফেশনাল হেডহান্টার্স, অর্থাৎ নরমুণ্ডশিকারী বনবাসীদের পক্ষেই সম্ভব। একটু ভেবে দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, মা কালীর ব্যাপারটা সাব-অলটার্ন স্টাডিজের একটা নতুন দিক উন্মোচন করে দিতে পারে। অত্যুগ্র লড়াইবাদী প্রগতির বিজয়-প্রতীক মা কালী—নানা ধরনের সামাজিক অন্যায়-অবিচারের শোধ একসঙ্গে তোলা হয়েছে তাঁর মধ্যে এবং চেষ্টা করা হয়েছে হৃত সুবিচার পুনঃপ্রতিষ্ঠার। আর্য-অনার্য, পুরুষ-নারী, সাদা-কালো, বিভিন্ন ধরণের অসাম্যের মোকাবিলা করছেন মা কালী একা।

যখনই একা বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকি, কিংবা গ্যাসের জন্যে লাইনে, তখন তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর পবিত্র কর্তব্য হিসেবে এই সব জরুরি তত্ত্ব মনোনিবেশ সহকারে চিন্তা করে চমকপ্রদ কিছু থিয়োরি আবিষ্কারের ব্যর্থ চেষ্টা করি। আফটার অল যুগটাই হচ্ছে আঁতেলপনার। ফিল্মস্টার বলুন, রিকশাওয়ালা, খেলোয়াড়, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, বাঈজি বলুন—সবাই এখন বুদ্ধিজীবী, সবাই আঁতেল। কবি-শিল্পী কিংবা মাস্টার-ফাস্টার হলে তো কথাই নেই। শুধু ধনী হলেই হয় না আজকাল। সকলকে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী হতেই হয়। অতএব, খানিকটা সোশিয়োলজি, খানিক অ্যানথ্রপলজি, খানিক সিম্পল পোস্ট-মডার্নিস্ট স্লোগানবাজি আর সেই উজ্জ্বল ধোঁয়াশার চনমনে পঞ্চরংয়ের নেশার সঙ্গে মার্ক্সসিস্ট-ফেমিনিস্ট-ডিকনস্ট্রাকশনিস্ট থার্ড ওয়ার্ল্ড-দৃষ্টিকোণের মুচমুচে চুরমুরভাজা মিশিয়ে যা-ই মুখে ফেলি না কেন, দেখি বেশ স্বাদু লাগছে। এটা আজ জগৎ জুড়েই সত্য।

একো-ফুকো-দেরিদা-লাঁকা।

চার নইলে মগজ ফাঁকা।।

আরে, পুজো তো কেবল পুজোই নয়, একটা নিগূঢ় সামাজিক ঐতিহাসিক প্রতীকী অভিজ্ঞতা। এর মধ্যে কত যে তর্ক তত্ত্ব তথ্য উত্তাপ পরিতাপ অনুতাপ অভিশাপ গিজগিজ করছে। এই ধরুন না বাঙালির পুজোর বাজার। সেটাও কি একটা সহজ ব্যাপার? ঠিকমতো ব্যাখা বিশ্লেষণ করতে বসলেই তো এর পরিপূর্ণ মূল্য বোঝা যাবে? সোশিও-ইকনমিক, ইকনমিক-হিস্টরিকাল, সোশিও-পলিটিকাল, কালচারাল-অ্যানথ্রোপলজিকাল, অ্যানথ্রোপো-অন্টোলজিকাল, হারমানিউটিক-সাইকো-ফেনোমেনন-লজিকাল— বাপ রে বাপ, কত যে জরুরি ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি থিসিস কতগুলো বিভিন্ন বিভাগের আন্ডারে করানো যেতে পারে, ইউজিসি মোটে থই পাবে না। ভেবেই যেন কলম নিশপিশ করে। দুর্গাপুজোর পুরো ব্যাপারটাই একটা প্রিজম পাথরের মতো— সাত দিকে সাতরঙা আলোর বিচ্ছুরণ ঘটানো দুর্গাপুজোর পক্ষে নস্যি। চোদ্দোরঙাও অসম্ভব নয়।

পুজো এসে গেল।

ভাবলেই মেন্টাল লোডশেডিংটা চলে যায়। যায় না? একটি ছোট্ট বাক্য, মাত্র তিনটি শব্দ, কী প্রচণ্ড তার জ্যোতি। তুলনীয় কেবল আর একটি ছোট্ট বাংলা বাক্য, তিন শব্দের, তারও আছে সাতটি অমরাবতী বইবার মতো অমেয় শক্তি— তাতে সব অন্ধকার দূর হয়, সব গুমোট কেটে যায়, খরায় বৃষ্টি নামে, বন্যার জল শুকিয়ে যায়— কিন্তু যায় কি?

পুজো তো উত্তরবঙ্গেও আসছে। আসছে বাংলাদেশের বানভাসি গ্রামাঞ্চলেও। যেখানে শিশুরা তিন দিন লাগাতার অভুক্ত, রাজীব গাঁধীর শান্তির প্রসাদ যেখানে বস্তাবন্দি হয়ে পুষ্পবৃষ্টির মতো ঝরে পড়েনি, মুহূর্তের মধ্যে যেমন পড়েছিল জাফনাতে। উন্মত্ত জলে ভেসে চলে গেছে গরু ছাগল বউ বাচ্চা, গাছের ওপরে উঠেও রক্ষা নেই জলতাড়িত মানুষের, সেখানে বিষাক্ত সাপ। বোধহীন সেই সরীসৃপেরা প্রাণভয়ে গাছে উঠে, সহাশ্রয়ী জীবকে ছোবল মারছে। এবং লাঠির ঘায়ে মরছে। গাছে সাপ, মাটিতে বন্যার ঘূর্ণি, আর ডুবন্ত জনশূন্য ভাঙাচোরা বসতিগুলোতে কী হচ্ছে? রাতবিরেতে ওরই মধ্যে চোর পড়ছে সেখানে, গরিবের যথাসর্বস্ব কেড়ে নৌকোয় পালাচ্ছে। সাপের ছোবলের চেয়ে কম বিষ নেই পাপের ছোবলে।

সভ্যতা কখনও কখনও এই রকম অতি নিম্ন স্তরে নেমে আসে, যখন ডুবুরি নামিয়ে মানুষের চরিত্রকর্দমের পলেস্তারা মাপবার প্রয়োজন পড়ে। বোকাচ্চিও ছিলেন এই রকম এক জন ডুবুরি। ১৩৪৮-এর কালামরণ যখন আধখানা ইউরোপকে মুছে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল, তখন ফ্লোরেন্সের পথেঘাটে তিনি মরিয়া মানুষের ঠিক এই জাতের স্বৈরাচার দেখে শিউরে উঠেছিলেন। ঘরে ঘরে জমে উঠেছে নামহীন শবদেহের স্তূপ, সৎকারের মানুষ নেই। স্বামী পালাচ্ছে স্ত্রীকে ফেলে, মা ছেড়ে যাচ্ছে সন্তানকে, তারই মধ্যে দস্যুতার নৃশংস তাণ্ডব চলছে। অবাধ লুঠতরাজ, নির্লজ্জ গণধর্ষণ, ধর্মযাজক অসহায় মানুষদের ফেলে ছুটে পালাচ্ছেন। গয়নার বাক্স বুকে আঁকড়ে। সে ছিল ছ’সাতশো বছর আগেকার ঘটনা। তারপর তো কত ওপর দিকে উঠেছি আমরা। উঠতে উঠতে মহাকাশে পৌঁছেছি নেমেছি চাঁদের মাটিতে। তবু পাতালের দিকে, পতনের দিকে, স্খলনের দিকটায় কি সেই অতটাই গভীর নীচে রয়ে গিয়েছি? নামতে নামতে আজও সেই একটা জায়গায় পৌঁছলে সভ্যতার মাপকাঠিটা ভেঙে যায়। বহিঃপ্রকৃতি যেই উথালপাথাল হয়, নিয়ম ভাঙে, এই গ্রহকে মৃত্যু দেয়, রিপুতাড়িত মানুষের অন্তঃপ্রকৃতি তক্ষুণি মানবাত্মার সব গৃহিণীপনা লণ্ডভণ্ড করে ফেলে হতকুৎসিত এক মুখশ্রী উদ্ঘাটিত করে। গর্তের সাপকেও লজ্জা দেয় মানুষের নৃশংস লোভ।

বন্যার্তের জীবনে সাপে-ভরা গাছ আর বেনোজলে ভাসা কুটিরের মধ্যে টানটান জীবনসত্যের টালমাটাল মুহূর্তে যে বর্বরতা এমন তীব্র রূঢ় স্পষ্টতায় ধরা পড়েছে, শহরের প্রাত্যহিক জীবনের সর্বংসহা স্থিতিস্থাপকতার গুণে সেইটাই চাপা পড়ে থাকে। অথচ অবিকল এই একই জিনিস কিন্তু সদাসর্বদা ঘটে চলেছে মধ্যবিত্তের জীবনে, কি শহর, কি গ্রামে। বন্যা, খরা, মড়কের দরকার নেই, নিত্যনৈমিত্তিক জীবনযুদ্ধের মধ্যেই আছে এই অস্তিত্বসংকট। কিন্তু তার ওপরে এমন তীব্র, নগ্ন, আলোর ফোকাস পড়েনি। বিপুল, সুনিয়ন্ত্রিত, অদৃশ্য লুঠতরাজ, আর নিঃশব্দ বিষাক্ত ছোবলের মধ্যে দিব্যি ডাল ধরে ঝুলে টিকে আছে অত্যাশ্চর্য জীবনীশক্তি নিয়ে শহরের নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ। সদাসন্ত্রস্ত, স্বস্তিহীন, উৎপীড়িত বিপন্ন এক অস্তিত্ব।

কিন্তু হায়, তারা নিম্নবর্গীয় নয়। তাদের উদ্ধারকর্তা নেই। তারাও যে ভদ্রলোক।

পুজো এসে গেল।

‘পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম’, মানুষের মধ্যে মনুষ্যধর্মকে পুনঃসংস্থাপিত করার জন্য যাঁর আসার কথা, বহিঃপ্রকৃতিকে পল্লবিত করার জন্য নবপত্রিকার প্রতীকে, আর অন্তঃপ্রকৃতিকে সঞ্জীবিত করার জন্য মাতৃকাবেশে যাঁর আসার কথা, তিনি কোথায়?

দুর্গতিনাশিনী দুর্গা, তুমি এসে হৃদয়ের লোডশেডিংটা দূর করো, নিরালোক স্বদেশকে একটু দ্যুতিময় করো। উত্তরবঙ্গে দাও এক টুকরো রোদ্দুর, রাজস্থানে এক খণ্ড কালো মেঘ, আর পঞ্জাবে কিছু প্রেম। চেয়ে দেখো, অভুক্ত, তৃষ্ণার্ত, সহায়সম্বলহীন বিদ্যাবঞ্চিত, সংস্কারাচ্ছন্ন দরিদ্র মানুষের মিছিল—প্রকৃতির কোপ-শান্তির জন্য কী অসীম ক্লেশ, কী যাতনা সহ্য করে একটু বৃষ্টির জন্য সুস্থ জীবনের আশায় তারা বুকে হেঁটে মন্দিরে চলেছে। এই তোমার বিশ শতকের ভারতবর্ষ। তোমার তৃতীয় নয়ন দিয়ে এক বার ভাল করে আমাদের দিকে তাকাও দিকি? কী দেখছ?

দেখছ বিদেশে বিশ্বভুবনে ভারতবর্ষ কী দারুণ ইমেজ সৃষ্টি করে চলেছে। একের পর এক উজ্জ্বল বিজয়দৃশ্য। নন-অ্যালাইন্‌ড জোট, শ্রীলঙ্কায় শান্তি, তৃতীয় বিশ্বের নির্ভীক স্বর ধ্বনিত হচ্ছে ভারতবর্ষের তরুণ কন্ঠে। দেশ-বিদেশে আমাদের নির্বাচিত নেতার শান্ত-সমাহিত দৃষ্টির, মধুর হাসির জয়ধ্বনি। অথচ স্বদেশে? গণতন্ত্রের অবস্থা কীসদৃশ? তুঘলকি কায়দায় মিউজিকাল চেয়ার খেলা হচ্ছে, আজ আছ কাল নেই। সত্য কথা বললে, আদর্শ আঁকড়ে থাকলে, চেয়ার ফসকাবে।

তুমি তো মা কেবল মজা দেখতেই আসো, অ্যানুয়াল ইন্সপেকশনে। তিন তিনটে চোখ, দশ দশটা হাত নিয়েও সামাল দিতে পারো না কিছুই। খরা-মারী-বন্যা-দাঙ্গা—সব চলছে, চলবে। তুমি ওই এক পিস অসুর নিয়েই বছরের পর বছর লড়ে যাচ্ছ, জন্ম-ইস্তক একই দৃশ্য দেখছি। নো চেঞ্জ। অতএব, যা দেবী সর্বভূতেষু ফুর্তিরূপেণ সংস্থিতা।

পুজো এসে গেল।

মনের এখন ভাল থাকার কথা। চার-পাঁচ দিনের জন্য মনের চোখে ফেট্টি, ঠোঁটে পট্টি, কানে তুলো, পিঠে কুলো। মন এখন মন্দ দৃশ্য দেখবে না, মন্দ বাক্য বলবে না, মন্দ শব্দ শুনবে না। মার খেলেও তা মাখবে না। বফর্সের বানান ভুলে যাবে। ভুলে যাবে গৃহবধূদহন আর আদিবাসিনী ধর্ষণ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর গ্যাস লিক, সন্ত্রাসবাদ আর কয়লাখনির ধস নামার ভয়ংকর দুঃস্বপ্নগুলো। মন এখন খুব সাজবে টুনি বাল্‌বের মালায়।

তার পর এক দিন এসে পড়বে বিজয়ার মিষ্টিমুখ। তার সঙ্গে বাংলা খবরের কাগজও। তার পরে? মন্ত্র-পড়া নবপত্রিকার গুণে তো গাছপালা আবার পত্রপুষ্পে সবুজ হয়ে উঠবে। কিন্তু হৃদয়? হৃদয়ের লোডশেডিং?

প্রথম প্রকাশ: ‘সর্বভূতেষু ফুর্তিরূপেণ সংস্থিতা’ শিরোনামে, পুজো ক্রোড়পত্র, ১৯৮৭। সংক্ষেপিত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2017 Archive
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE