ক্রিকেট নামক ঔপনিবেশিক খেলাটির ভবিষ্যৎ কী, সে বিষয়ে বিলক্ষণ সংশয়ের অবকাশ আছে। যতই অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ জয়কে নিয়ম বানাইয়া ফেলুক, খেলাটি এখন মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের। সেই চারটি দেশের মধ্যে আবার নিছক বাজারের জোরেই ভারতের বাহুবল বিসদৃশ রকম বেশি। বিশ্বমঞ্চে সেই বাহুবল প্রদর্শনে ভারত কিছুমাত্র কুণ্ঠিতও নহে। কিন্তু, ‘ভদ্রতা’ বস্তুটি যে এখনও বিলুপ্ত হয় নাই, কথাটি মনে না রাখিলে মুশকিল। নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন এই কথাটি বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছেন। বিজয়ী দলের হাতে বিশ্বকাপ তুলিয়া দেওয়ার সম্মানের মোহে তিনি কোনও নিয়মের তোয়াক্কা করেন নাই, ভদ্রতার মুখোসটুকুরও ধার ধারেন নাই। প্রথা অনুযায়ী, বিজয়ী দলের অধিনায়কের হাতে কাপ তুলিয়া দেওয়ার অধিকার ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিসি-র প্রেসিডেন্টের। সেই পদে ছিলেন বাংলাদেশের মুস্তাফা কামাল। শ্রীনিবাসন সম্ভবত ভাবিয়াছেন, তিনি উপস্থিত থাকিতে বাংলাদেশের ন্যায় ‘অকিঞ্চিৎকর’ দেশের প্রতিনিধি এই সম্মান পাইবেন, তাহা হইতে পারে না। অতএব, কিছু কুযুক্তি খাড়া করিয়া তিনি কামালের অধিকারটি ছিনাইয়া লইলেন ও পুরস্কার প্রদানের গুরুদায়িত্ব স্বস্কন্ধে লইলেন। মাঠে উপস্থিত দর্শকরা তাঁহাকে যে ভঙ্গিতে ‘অভ্যর্থনা’ জানাইয়াছে, তাহা উৎসাহব্যঞ্জক নহে। কিন্তু শ্রীনিবাসন সম্ভবত দর্শকদের উষ্ণ অভ্যর্থনার অপেক্ষায় ছিলেন না। কাপ হাতে ছবি তুলিয়াই তিনি খুশি।
ভারত-বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে আম্পায়ারিং-এর মান লইয়া প্রশ্ন তোলা মুস্তাফা কামালের উচিত হইয়াছিল কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। অস্বীকার করিবার উপায় নাই, আইসিসি-র প্রেসিডেন্ট পদে থাকিয়া এই কাজটি করা যায় না। যত ক্ষণ তিনি এমন একটি পদে আসীন, তত ক্ষণ তাঁহার কোনও বক্তব্যই ব্যক্তিমাত্রের নহে, সেই পদের। তাঁহার নিকট বাক্-সংযম প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু, শ্রীনিবাসন যে ভঙ্গিতে কামালের ভুলের বিচার করিয়া শাস্তি বিধান করিয়া ফেলিলেন, তাহা নিন্দার অতীত। আইসিসি পাড়ার ক্লাব নহে। তাহার সংবিধান আছে। কোনও পদাধিকারী অধিকারভঙ্গের কাজ করিলে কিংকর্তব্য, তাহা সেই সংবিধানের পথনির্দেশ মানিয়াই স্থির করা বিধেয়। তাহার নির্দিষ্ট পদ্ধতি রহিয়াছে। শ্রীনিবাসন প্রায় খাপ পঞ্চায়েত চালাইবার ভঙ্গিতে কামালের বিচার সারিয়া ফেলিলেন। দেখা গেল, তিনিই বাদীপক্ষের উকিল, তিনিই বিচারক। যেহেতু ক্রিকেটে ভারতের আর্থিক পেশিবল সর্বাধিক, অন্য কোনও পক্ষ তাঁহার এই অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদও করিলেন না। ইহাতে শুধু শ্রীনিবাসনের ব্যক্তিগত উচ্চাশা পূর্ণ হইল মাত্র। ক্রিকেটের স্বার্থরক্ষা হইল না, আইসিসি-র সম্মানও বাঁচিল না।
অবশ্য, শ্রীনিবাসনের নিকট সম্ভ্রমজনক আচরণের প্রত্যাশা করিবার উপায়ও নাই। তাঁহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠিবার পরেও তিনি যে ভাবে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের ক্ষমতা আঁকড়াইয়া ছিলেন, এবং তাহার ফলে দেশের শীর্ষ আদালতকে যে ভাষায় তাঁহাকে তিরস্কার করিতে হইয়াছে, তাহাতে স্পষ্ট, তিনি সম্মানের পরোয়া করেন না। ক্ষমতাই তাঁহার একমাত্র কাম্য। তাঁহাকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। ভারতের আর্থিক শক্তি বা আইপিএল-এর আকর্ষণের নিকট নতিস্বীকার না করিয়া আইসিসি-র সদস্যদের উচিত ছিল, এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করা। ক্রিকেটকে বাঁচাইবার আর কোনও পথ নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy