Advertisement
১৮ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

আসমুদ্রহিমাচল, ভোটের নয়, বাঁচার লড়াই

পরিবেশ বাঁচাতে একজোট হয়ে লড়ছেন স্থানীয় মানুষ। পরিবেশ না বাঁচলে তাঁদের জীবন আর জীবিকাও মরবে। কোনও বড় কথা নেই। কোনও নীতির বাগাড়ম্বর নেই। সাধারণ মানুষের নিজস্ব ভাষায় উঠে আসে আন্দোলনের মর্মকথা। খুলে যায় রাষ্ট্রের মুখোশ।এশিয়ার ‘সবচেয়ে বড় বিনোদন পার্ক’ তৈরির প্রকল্প শুরু হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। যৌথ উদ্যোগে। তখন মানুষ কিছু না বুঝেই জমি বিক্রি করেছে। প্রায় সাতশো একর বাদাবন আর ধানখেত, আমবাগান, কাজুবাদাম, বাঁশগাছের বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংস করে ওই পার্ক তৈরি হয়েছে। ওখানে পাহাড় ছিল। সমুদ্রের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, এই রকম খাঁড়ি দিয়ে ঘেরা ছিল গোটা এলাকাটা। পাহাড় গুঁড়িয়ে দেওয়ায় পার্শ্ববর্তী বাদাবনও নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। ধ্বংসের চেহারাটা বুঝতে পেরে স্থানীয় মানুষ আন্দোলন শুরু করেন। সরকার তখন উদ্যোগীদের বলে একটা চ্যানেল করে দিতে, যাতে অন্তত খাঁড়ির জলটা পাওয়া যায়। তাতে বাদাবন অল্প হলেও বেঁচেছে।

জল সত্যাগ্রহ। তামিলনাড়ুর কুড়নকুলম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। সেপ্টেম্বর ২০১২।  ছবি:  এএফপি।

জল সত্যাগ্রহ। তামিলনাড়ুর কুড়নকুলম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। সেপ্টেম্বর ২০১২। ছবি: এএফপি।

বোলান গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৩০
Share: Save:

এশিয়ার ‘সবচেয়ে বড় বিনোদন পার্ক’ তৈরির প্রকল্প শুরু হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। যৌথ উদ্যোগে। তখন মানুষ কিছু না বুঝেই জমি বিক্রি করেছে। প্রায় সাতশো একর বাদাবন আর ধানখেত, আমবাগান, কাজুবাদাম, বাঁশগাছের বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংস করে ওই পার্ক তৈরি হয়েছে। ওখানে পাহাড় ছিল। সমুদ্রের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, এই রকম খাঁড়ি দিয়ে ঘেরা ছিল গোটা এলাকাটা। পাহাড় গুঁড়িয়ে দেওয়ায় পার্শ্ববর্তী বাদাবনও নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। ধ্বংসের চেহারাটা বুঝতে পেরে স্থানীয় মানুষ আন্দোলন শুরু করেন। সরকার তখন উদ্যোগীদের বলে একটা চ্যানেল করে দিতে, যাতে অন্তত খাঁড়ির জলটা পাওয়া যায়। তাতে বাদাবন অল্প হলেও বেঁচেছে। খাঁড়িতে এত মাছ ছিল যে, জেলেরা বর্ষার তিন মাস ওখানে থেকে যেতেন মাছ ধরতে, সমুদ্রে যেতেন না। ‘ওই পার্ককে কেন্দ্র করে অনেক বড় বড় হোটেল হয়েছে। তাদের বর্জ্য খাঁড়ির জল দূষিত করে দিয়েছে, আর মাছ হয় না। খাঁড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

মহারাষ্ট্রের গোরাই গ্রামে লুডস ডি সুজা-র বাড়ির বারান্দায় বসে অঞ্চলের পরিবেশ বাঁচানোর গল্প শুনছিলাম নেভিল ডি সুজা আর লুডস-এর কাছে। জমি দিয়েছিলেন যাঁরা, দু’বছরের মধ্যে তাঁরা কপর্দকহীন, কর্মহীন হন। ‘তবু তো কিছু টাকা তাঁরা পেয়েছিলেন। কিন্তু যিনি একটা নৌকা সম্বল করে পরিবার প্রতিপালন করেন, সেই গরিব মানুষটি? কে ভাববে তাঁর কথা?’ মুম্বই শহর থেকে তেমন দূরে নয় এই অঞ্চল। সমুদ্রের ধারে বড় বড় রিসর্ট হয়েছে। সমুদ্রের মাছকে কেন্দ্র করে এলাকার অর্থনৈতিক ভিত্তিটি তৈরি হয়েছিল। এখানকার এক গ্রামের একটা খোলা সরকারি জায়গায় পুরসভা এলাকার সমস্ত বর্জ্য নির্বিচারে ফেলে যেত। কালে কালে আবর্জনার পাহাড় হয়ে গেছে। ময়লা মাটির সঙ্গে মিশে খাবার জলকেও দূষিত করছিল। জলবাহিত অসুখ বেড়েই চলছিল। স্থানীয় এম এল এ, এম পি, কালেক্টরকে বার বার জানিয়েও কিছু হয়নি। ২০০৯-এ দশটি গ্রাম মিলে তৈরি হয় ‘পর্যাবরণ সংরক্ষণ সমিতি: নাগ্রি হক্ (সিটিজেন রাইট)’। স্থানীয় মাতব্বরদের নানা অভিসন্ধি সামলে, পুলিশের লাঠি খেয়ে আদালতের রায়ে শেষ পর্যন্ত ওই জায়গাটিকে আবর্জনামুক্ত করা গেছে। কোনও স্তরের জনপ্রতিনিধিদের দিয়েই কাজটি কিন্তু করানো যায়নি।

এই আন্দোলনের সূত্রেই এখানকার মানুষ জানতে পারেন, এলাকার আরও দশটি গ্রামের জমি নিয়ে ‘বহুমুখী এস ই জেড’-এর পরিকল্পনা আছে। ‘এস ই জেড’ কী, তখন জানতেনও না ওঁরা। আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝেন যে, দল বেঁধে কাজ করতে হবে। সবাই এককাট্টা হন। ‘গোরাই বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতি’ তৈরি হয়। কালেক্টর, মন্ত্রী সবার সঙ্গে দেখা করেন ওঁরা। জানতে চান, এত মৎস্যজীবী যে জীবিকা বিসর্জন দিতে বাধ্য হবেন এস ই জেড তাঁদের কী দেবে? কোথায় হবে পুনর্বাসন? জবাব মেলেনি। অতএব লড়াই জারি আছে। ওঁদের বক্তব্য: সরকার বা কোম্পানি যদি অন্য জীবিকার জন্য প্রশিক্ষিত করে ও জীবিকা নিশ্চিত করতে পারে, তবেই এ জমি বিক্রির কথা ভাবতে পারেন।

খাঁড়ি দিয়ে ঘেরা মহারাষ্ট্রের রত্নগিরির চিপলুন ব্লকের ৪৪টি গ্রাম। তারই একটি গ্রাম গাংগ্রাইয়ে রত্নপ্রভা হরিশ্চন্দ্র পাড়য়ালেরির কাছে এক কাহিনি শুনেছিলাম। প্রায় আড়াইশো শিল্প নিয়ে একটি শিল্পতালুক হয়েছিল। কুড়ি বছরের মধ্যে সংখ্যাটি নেমে গিয়ে দাঁড়ায় চুরাশি। পরিস্রুতির ব্যবস্থা না হওয়ায় শিল্পতালুকের বর্জ্য খাঁড়ির জল দূষিত করে দেয়। মাছ আর আসে না। এলেও মরে যায়। গ্রামবাসীরা জীবিকা হারান। রত্নপ্রভা বলেন, ‘এখানকার মানুষ আগে কখনও বাইরে কাজ করতে যায়নি। আমাদের বিয়ে-শাদিও এই ৪৪ গ্রামের মধ্যেই হয়েছে। এখন প্রায় সব পরিবারের এক জন না এক জনকে যেতেই হবে মুম্বই। অথচ কারখানা তো বন্ধ হয়ে গেল। কার কী লাভ হল?’ এখানেও তৈরি হয়েছে সংঘর্ষ সমিতি। লড়াই চলছে। শিল্প হতে দিতে আপত্তি নেই ওঁদের, কিন্তু খাঁড়ির জল, বাতাস, পশুপালন ক্ষেত্র এ সব নষ্ট করা চলবে না।

গোটা দেশ জুড়ে পরিবেশ, এবং তার উপর নির্ভরশীল জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে নানা আন্দোলন তৈরি হয়ে উঠছে। পরিবেশ না বাঁচলে যে জীবিকা বিপন্ন এ কথা মানুষ অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছেন। যেমন বুঝেছেন, জমি যদি দেওয়াও হয়, সরকার বা জমির মালিক কোম্পানিগুলি সর্বদা তার যথাযোগ্য ব্যবহার করতে পারে না। ফলত এ-দিক ও-দিক দু’দিকই যায়, কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি অর্থহীন প্রহসনে পরিণত হয়।

ওড়িশার গঞ্জাম জেলার ব্রহ্মপুর আর ছত্রপুর ব্লক মিলিয়ে সাত হাজার একর জমির ওপর ইস্পাত প্রকল্পের জন্য ১৯৯৫ সালে মউ স্বাক্ষরিত হয়। পঁচিশটি গ্রামের মানুষ তৈরি করেন ‘গণ সংগ্রাম সমিতি’। ১৯৯৬ সালে লাঠি-গুলি চালিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে চার হাজার একর জমির দখল নেয় সরকার। দু’জন মহিলা মারা যান। ত্রিশ হাজার মানুষ গৃহহীন হন। সেই জমি কিন্তু কুড়ি বছর পরেও কোনও কাজে আসেনি। পুরোটা পাঁচিলও দেওয়া হয়নি। ‘গণসংগ্রাম সমিতি’ ভেঙে গেছে। তৈরি হয়েছে ‘সমাজ সুরক্ষা সমিতি’। ৪০০০ একর অধিগৃহীত জমির ক্ষতিপূরণ এখনও মেলেনি। ‘সমাজ সুরক্ষা সমিতি’ পাহারা দেয়, যাতে তাদের এড়িয়ে কেউ না ঢুকতে পারে; আর সরকার পাহারা দেয়, যাতে সাধারণ গ্রামবাসী না ঢুকে পড়ে। ভেতরে একটা শিবমন্দির আছে। তার পূজারি এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে।

ওড়িশার কলিঙ্গনগরে একটি ইস্পাত প্রকল্পের জন্য প্রায় সাতশো পরিবার উচ্ছিন্ন হয়েছিল। এখন তাদের অনেকে পাথর ভাঙে, কেউ ভিক্ষে করে। মাটির নীচের জল দিয়ে কারখানা চলে, ফলে এলাকার যাবতীয় ঝর্না শুকিয়ে গেছে। তিরতিরে একটি পাহাড়ি নদী আছে, বছরের বেশি সময়ই আজকাল জল থাকে না। পুকুরও শুকনো। ৩৫০ ফুট পর্যন্ত কুয়ো না খুঁড়লে জল ওঠে না।

মহারাষ্ট্রের ‘পেন’ তালুকের ওড়াও গ্রামে এক ব্যতিক্রমী মানুষের দেখা পেয়েছিলাম। গণেশ ঠাকুর। অনেকটা পারিবারিক জমি ছাড়াও নানান পারিবারিক ব্যবসা আছে তাঁদের। এলাকায় এক বেসরকারি সংস্থার প্রকল্পের জন্য ২০০৬-এ যখন জমি অধিগ্রহণের নোটিশ আসে, তিনি সেই সংস্থার তরফে অধিগ্রহণের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। কিন্তু এলাকায় ‘২৪ গাঁও’ সংগঠন গড়ে ওঠে। তার পর গড়ে ওঠে ‘মহা মুম্বই সংঘর্ষ সমিতি’, গ্রামবাসীরা ধরনা, জমায়েত, মিছিল করেন। জেল হয় বহু লোকের। মেয়েদেরও। খবর নিতে গিয়ে জীবনে প্রথম ‘এস ই জেড’ শব্দটি শোনেন ওঁরা। মানে বুঝতে হিমশিম। শেষে যখন বুঝতে পারলেন, তখন গণেশ অবাক। “ওরা আমাকে একদম উল্টো বুঝিয়েছিল! এলাকায় মানুষের ওপর আমার প্রভাব আছে বলে সেটা খাটাতে চাইছিল।” এই উপলব্ধির পর আন্দোলনে যোগ দেন গণেশ, দ্রুত তার নেতৃত্বে চলে আসেন। এক বার তাঁর অশীতিপর মা অনশনে অংশ নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এলাকার মানুষের মুখে মুখে সেই ঘটনা ঘোরে।

কোনও রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় এই সব আন্দোলন তৈরি হয়নি। সর্বত্র শুনেছি, ‘আমরা কোনও দলের কাছ থেকে টাকা নিইনি।’ কোথাও কোথাও স্থানীয় ভাবে কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা বা অঞ্চলের বিধায়ক এগিয়ে এসেছেন, আবার পিছিয়েও গেছেন। যথার্থ অর্থে আন্দোলনের রাশ থেকেছে জনগণের হাতে। এমনও দেখেছি, বিজেপির সদস্য আর সি পি এমের সদস্য এই একটি বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করছেন। জানতে চেয়ে উত্তর পেয়েছি: “এটা তো আমাদের গ্রামের ব্যাপার।” এই সব আন্দোলনের একটাই উদ্দেশ্য: সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার সুরক্ষা। তাঁদের সসম্মান বেঁচে থাকার অধিকারের স্বীকৃতি আদায়। ওড়িশার একটি এলাকায় ‘বিস্থাপন-বিরোধী জনমঞ্চ’র নেতা বললেন, ‘কোনও সাহায্য, কোনও পরামর্শ পাইনি কারও কাছ থেকে। কেবল আমরা এককাট্টা হয়ে রুখে দিয়েছি।’ আর তাই আত্মবিশ্বাস আছে গ্রামবাসীদের, তাঁরা নিজেরাই পারবেন নিজেদের রক্ষা করতে।

আসমুদ্রহিমাচল ভোটের গরম হাওয়া বইছে। সকলের হাতে ‘স্বপ্নের ইন্ডিয়া’। এই লড়াই যদি গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ পার্বণ হয়, তা হলে বলতেই হবে, তা কখনওই সর্বজনীন নয়। কারণ, গ্রামগ্রামান্তরের যে নতমুখী ভারত, এই উৎসবে তার কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই। তার সমস্যা তার দিনানুদৈনিক যন্ত্রণা এই ভোটের লড়াইয়ে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। অথচ, তার নাম করেই ভোটের লড়াই। এ এক অদ্ভুত প্যারাডক্স।

এই সব আন্দোলনের কোনও বড় কথা নেই। কোনও নীতির বাগাড়ম্বর নেই। একেবারে সাধারণ মানুষের নিজস্ব ভাষায় উঠে আসে আন্দোলনের মর্মকথা। খুলে যায় রাষ্ট্রের মুখোশ। এবং হয়তো সংসদের অসারতাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

probondho bolan gangopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE