নতুন সরকারের ‘প্রথম একশো দিন’ নিয়ে খামখা শোরগোল হচ্ছে। এর কোনও মানেই নেই। নতুন সরকারকে একশো দিনের জন্য গদিতে বসানো হয়নি, তারা ক্ষমতায় এসেছে পাঁচ বছরের জন্য। ‘একশো দিনে দুনিয়া পালটে দেব’ বলে প্রথমটায় খুব বাহবা কুড়নো যেতে পারে, কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে না পারলে বেজায় ঝামেলা। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে একশো দিনের কর্মসূচি প্রচার করেছিল। ফল কিছুই হয়নি।
এ দেশে একটা কথা খুব চলে। নতুন সরকার যদি শুরুতেই হইহই করে সংস্কারের কাজ করে ফেলতে না পারে, তা হলে আর সে সব কাজ হয়ে ওঠে না, গতানুগতিকতা তাদের গ্রাস করে নেয়, নানা প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, সে সব বাধা ঠেলে এগোনো কঠিন হয়ে পড়ে। ১৯৯১ সালের আর্থিক সংস্কারের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই এ কথা বলা হয়। কিন্তু সেই সংস্কার ছিল একটা বড় রকমের আর্থিক সংকটের মোকাবিলার সঙ্গে জড়িত, অপেক্ষা করার সময় ছিল না। তা ছাড়া, লাইসেন্স রাজ রদ করার মতো কাজ যে ভাবে শুরুতেই করে ফেলা যায়, অন্য অনেক সংস্কারের ক্ষেত্রেই সেটা সম্ভব নয়। আর, ১৯৯১ বাদ দিলে এ-রকম ঝটিকা-সংস্কার ভারতে আর কখনও বিশেষ দেখা যায়নি।
সরকারকে নিশ্চয়ই দ্রুত কাজ করতে হবে, সাধারণ মানুষ অনন্ত কাল সরকারের কাজ দেখার আশায় বসে থাকবেন না, কিন্তু এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, তাঁরাও প্রথম একশো দিনে ম্যাজিক দেখতে চান। প্রতিশ্রুতি পূরণের ব্যাপারে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণের জন্য একটা নতুন সরকার কত দিন সময় পায়? মোটের ওপর বলা চলে, এক বছর। সেটাই ‘মধুচন্দ্রিমার কাল’। একশো দিনে বছর হয় না।
ভোটদাতাদের কাছে জরুরি বিষয়ের তালিকায় প্রথমেই থাকবে তিনটি জিনিস: আয়বৃদ্ধি, বাজারদর নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্নীতি নিবারণ। এগুলো সকলের কাছেই গুরুতর ব্যাপার। কিন্তু মনে রাখতে হবে, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসছে দিল্লিতে। অনেক বিষয় আছে, যেগুলি দিল্লির, মানে কেন্দ্রের এক্তিয়ারে নয়, রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে। এবং, অনেক কিছু পালটাতে গেলে আইন পালটানোর দরকার হয়, তাতে সময় লাগে, বিশেষ করে যেখানে রাজ্যসভার অনুমোদন চাই সেখানে তো আরওই সমস্যা। এটা ঠিকই যে, একটা অচল সরকারের জায়গায় আমরা একটা সচল সরকার পেতে চলেছি। কিন্তু তার ফলে সব কিছু ঝড়ের গতিতে চলবে, এমন একটা প্রত্যাশা না রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
এটা পরিষ্কার বুঝে নেওয়া ভাল যে, সরকারি কর্মসূচিতে সেই সব বিষয়ই অগ্রাধিকার পাবে, যেগুলিকে সরকার গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে, বিদেশি বিনিয়োগকারী বা লগ্নির বাজারের অগ্রাধিকার অনুসারে তারা চলবে না। তাই এ কথা ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই যে, সরকারি কর্তারা বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ, শ্রম বিরোধ আইন, ভর্তুকি ইত্যাদি বিষয়গুলিকে প্রাথমিক গুরুত্ব দেবেনই। দেবেন কি না, কতটা দেবেন, সে-সবই নির্ভর করবে তাঁদের নিজেদের স্বাথের্র ওপর। এটা মাথায় রেখেই আমরা সরকারের আশু কর্তব্য বিষয়ে কয়েকটা কথা বলতে পারি।
প্রথম কথা হল, প্রশাসনের ঘাটতি পূরণ করে সরকারকে সচল করতে হবে, সেটাই এক নম্বর কাজ। এর অর্থ, প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব অফিস (পিএমও), ক্যাবিনেট (মন্ত্রী গোষ্ঠী বা জিওএম নয়) এবং আমলাতন্ত্রের কর্মতৎপরতা বাড়ানো জরুরি। ইউপিএ জমানায়, বিশেষত দ্বিতীয় পর্বে সেটা একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয়ে আইন সংশোধনের দরকার, কিন্তু অন্য কিছু বিষয়ে সরকার সরাসরি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সংসদে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু সত্য এই যে, অনেক সংস্কারই রাজ্য সরকারগুলির ওপর নির্ভর করবে। যেমন, উপভোক্তাদের খাদ্য এবং অন্য বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভর্তুকি ঠিক ভাবে দিতে হলে রাজ্যের সহযোগিতা অপরিহার্য। যেমন, দারিদ্র সীমার নীচে (বিপিএল) কারা আছে সেটা চিহ্নিত করার জন্য রাজ্যের সাহায্য চাই, বিভিন্ন প্রকল্প চালানোর খরচ রাজ্য সরকার কতটা ভাগ করে নেবে, সেটাও জানা দরকার। সরাসরি নগদ টাকা হস্তান্তর করে ভর্তুকি দেওয়ার কথা বলা সহজ, করা কঠিন। আধার প্রকল্পের হাল দেখলেই সেটা বোঝা যাবে। এই পুরো ব্যাপারটাই কেন্দ্র এবং রাজ্যের সহযোগিতার ভিত্তিতে পরিচালনা করা দরকার। তেমনই, পণ্য এবং পরিষেবা কর (জিএসটি) কাঠামোয় যে সামগ্রিক সংস্কারের পরিকল্পনা অনেক দিন ধরে চলছে, রাজ্যের সহযোগিতা ছাড়া তা কার্যকর করা যাবে না। এ ব্যাপারে এখনও অনেক মতানৈক্য আছে। তা ছাড়া জিএসটি’র নতুন নিয়ম চালু হলে রাজ্য সরকারের রাজস্ব কমে যেতে পারে, এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, সে বিষয়েও একটা পরিষ্কার ব্যবস্থা করা দরকার।
আর একটা উদাহরণ হল কর্মসংস্থান গ্যারান্টি প্রকল্প। এই কর্মসূচির জন্য প্রণীত আইন সংশোধন করে রাজ্যের হাতে প্রকল্প রূপায়ণের বাড়তি ক্ষমতা দিতে চাইলে রাজ্যের সহযোগিতা চাই। এ সবই সময়সাপেক্ষ। আপাতত হয়তো কেন্দ্রীয় সরকার এই কাঠামোর মধ্যেই রাজ্যকে কিছু বাড়তি স্বাধীনতা দিতে পারে, যাতে এই সব প্রকল্পে সম্পদ সৃষ্টির পরিমাণ বাড়ে।
কৃষিপণ্যের বিপণন সংক্রান্ত নিয়মকানুন পালটানোর কথা বলা হচ্ছে। ফুড কর্পোরেশনের সম্পূর্ণ পুনর্গঠন অবশ্যই করা দরকার। কিন্তু ঘটনা হল, কৃষি সম্পর্কিত বহু বিষয়ই রাজ্যের এক্তিয়ারে। দিল্লি কী করতে পারে? শিল্পবাণিজ্যের উদ্যোগে দ্রুত ছাড়পত্র দেওয়ার ব্যাপারেও প্রশ্ন একই, কারণ বেশির ভাগ ছাড়পত্রই রাজ্য সরকারের হাতে। কেন্দ্রীয় সরকার যেটা করতে পারে, তা হল রাজ্যের হাতে আরও ক্ষমতা তুলে দেওয়া এবং যে সব রাজ্য সংস্কারের পথে হাঁটবে, বিশেষ সুযোগসুবিধা দিয়ে তাদের উৎসাহিত করা। যেমন, রাজকোষ ঘাটতি কমাতে পারলে বাড়তি কেন্দ্রীয় সাহায্য দেওয়া।
এই সূত্রেই বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন ওঠে। এ বিষয়ে নতুন সরকারকে উদ্যোগী হতে হবেই। কিন্তু মনে রাখা দরকার, যে রাজকোষ তারা উত্তরাধিকার সূত্রে পাচ্ছে, তার অবস্থা ভয়াবহ। ভূতপূর্ব অর্থমন্ত্রীর হিসেবনিকেশে প্রচুর কৌশল ছিল, সরকারি আয়ব্যয়ের প্রকৃত অবস্থা তাঁর বাজেটে ধরা পড়েনি। আরও একটা কথা মনে রাখতে হবে সুদ, বেতন, পেনশন ইত্যাদি অনেক খরচই আপাতত বাঁধা, সরকার তা কমাতে পারে না, বড়জোর মন্ত্রিসভা এবং সামগ্রিক ভাবে প্রশাসনের মেদ কমিয়ে কিছুটা ব্যয়সংক্ষেপ করতে পারে। তার ওপর, মূলধনী ব্যয় বাড়াতে হবে, প্রতিরক্ষা ব্যয়ও। রাজস্ব বাড়ানোর আশু উপায় বিশেষ নেই, জিএসটি এবং প্রত্যক্ষ আয়কর বিধি (ডিটিসি) সংস্কারের কাজ জুলাইয়ের বাজেটে করে ফেলার কোনও সম্ভাবনা নেই। বড়জোর কর আদায় বিষয়ক মামলার সহজ নিষ্পত্তি নিয়ে ঘোষণা থাকতে পারে, হয়তো রেট্রোস্পেকটিভ কর সম্পর্কেও একটা স্পষ্ট অবস্থান ঘোষণা করা হবে। ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার সংস্কার নিয়েও অনেক দিন ধরেই নানা কথা চলছে। মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সীমিত শেয়ার বিক্রয় করে মূলধন বাড়ানো এক কথা, আর ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণ অন্য জিনিস।
আর একটু সময় নিয়ে যে সব কাজ করা দরকার, তার মধ্যে অবশ্যই আছে পরিকাঠামোর প্রসার। নতুন সরকারকে সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতেই হবে। জোর দিতে হবে পরিবহণ, জল সরবরাহ, বিদ্যুৎ ইত্যাদির ওপর। তেমনই, তথ্যপ্রযুক্তিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি কাজে লাগানোর বিরাট প্রয়োজন আছে, সুযোগও। আবার, কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য একটা দীর্ঘমেয়াদি নীতি দরকার, কৃষির ফলন বাড়ানোর নীতি। কিন্তু যে সব জায়গায় কৃষিপণ্যের ফলন চাহিদার চেয়ে বেশি এবং যেখানে তা কম, দু’ধরনের এলাকার মধ্যে একটা সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা অনেক তাড়াতাড়ি করা যেতে পারে। এ ধরনের সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়োজন অন্য ক্ষেত্রেও আছে। যেমন, কোন অঞ্চলে কী ধরনের দক্ষতা দরকার, তার একটা পরিষ্কার হিসেব করা দরকার, সেই অনুসারে দক্ষতা সৃষ্টির কার্যক্রম নিতে হবে। স্পষ্টতই, এগুলো সময়সাপেক্ষ।
আমি মনে করি, এক ধাক্কায় বিরাট একটা পরিবর্তন ঘটবে, একটা ‘বিগ ব্যাং’ হবে, এমন আশা করার কোনও যুক্তি নেই। অনেকেই ধরে নেন, সরকারি প্রশাসনের কাঠামো একই থাকবে, কিন্তু সরকার বড় বড় নীতি পরিবর্তনের ঘোষণা করবে, আর তাতেই সব কিছু পালটে যাবে। এ-রকম হয় না, হওয়ার কারণ নেই। আমি মনে করি না, তিন মাসের মধ্যে খুব বিরাট কোনও পরিবর্তন হবে, জুলাই মাসের বাজেট পৃথিবী কাঁপিয়ে দেবে। কিন্তু আমি আশা করব, সরকারি কাঠামোটার সংস্কার করা হবে। একটা নতুন শাসনকাঠামো তৈরি হবে। সেটাই হবে সত্যিকারের বিগ ব্যাং।
দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy