Advertisement
১৭ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

কিন্তু আঁস্তাকুড়নিবাসীদের কাছেও পৌঁছনো চাই

জনসাধারণের একটা বড় অংশ তৃণমূলকে বামপন্থীদের বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কেন, সেটা বোঝা প্রয়োজন। এক কথায় সবাইকে লুম্পেন, সমাজবিরোধী হিসেবে দাগিয়ে দিলে নিজের পবিত্রতা জাহির হয় বটে, জনবিচ্ছিন্নতা দূর হয় না।জনসাধারণের একটা বড় অংশ তৃণমূলকে বামপন্থীদের বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কেন, সেটা বোঝা প্রয়োজন। এক কথায় সবাইকে লুম্পেন, সমাজবিরোধী হিসেবে দাগিয়ে দিলে নিজের পবিত্রতা জাহির হয় বটে, জনবিচ্ছিন্নতা দূর হয় না।

নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ। ভয়ার্ত গ্রামবাসীর কাছে সিপিআইএম নেতা বিমান বসু। মাখড়া, বীরভূম, ১ ডিসেম্বর। ছবি: পিটিআই।

নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ। ভয়ার্ত গ্রামবাসীর কাছে সিপিআইএম নেতা বিমান বসু। মাখড়া, বীরভূম, ১ ডিসেম্বর। ছবি: পিটিআই।

উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

খাগড়াগড় কাণ্ড নিয়ে যখন রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতিতে তোলপাড় অব্যাহত, সেই অবসরে নেহাত খেয়ালবশত চলে গেছিলাম খাগড়াগড় সন্নিহিত বর্ধমান শহরে। দেখলাম, সেখানকার জনজীবন আপন উদ্যমে স্থিত। কোথাও টোল খায়নি তার স্বাভাবিকতা। শহরের প্রাণকেন্দ্রে সংস্কৃতি মঞ্চকে ঘিরে চলেছে চলচ্চিত্র উৎসব। উৎসাহী কর্মকর্তা ও দর্শকদের আনাগোনায় স্নিগ্ধ সন্ধ্যা। শুধু গাড়ি নিয়ে গেলে রাখতে হচ্ছে একটু সন্তর্পণে। শহরে এনআইএ আছে, এই যা!

এলোমেলো ঘুরে বেড়ানোর একটা মজা আছে। অতশত ভেবেচিন্তে আগে থেকে স্থির করে লোকের সঙ্গে মিশতে হয় না। দীর্ঘ পরিচয়ের গ্লানি বহন করার দরকার নেই। নতুন করে একটা যাত্রা শুরু করা যায়। অগ্রজপ্রতিম শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী আবুল হাসানের সৌজন্যে পরিচয় হল বর্ধমানের সিপিআইএম নেতা অরিন্দম কোঙারের সঙ্গে। দেখে মনে হল, হরেকৃষ্ণ কোঙারের পুত্রের কোনও ঐতিহাসিক পিছুটান নেই। মনে হল, তিনিও কিছুর সন্ধানে ব্রতী।

কী সেই সন্ধান? আমাকে বললেন, ‘আমরা তো পার্টিকে দেখি ভিতর থেকে। সে দেখা এক রকম। আপনারা বাইরে থেকে কী ভাবে দেখেন জানতে ইচ্ছে করে। আমাদের দলে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা আছেন। নতুন ছেলেমেয়েরা সে ভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে না কেন বলুন তো?’ সিপিআইএম নেতাদের বক্তব্য পেশ করা ও সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার কালচারেই আমরা বড় হয়েছি। প্রশ্ন আমরা করেছি, তাঁরা ‘অর্বাচীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, অরিন্দমবাবুর প্রশ্নটা শুনে প্রথমে কিছু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

তিনিই সহজ করে দিলেন। ‘বলুন আপনি, বলুন! আমরা শুনতে চাই।’ এ বার উত্তর দিলাম, ‘শ্রেণি-চেতনার উপর পার্টি-চেতনা আধিপত্য বিস্তার করেছে, তাই এই অবস্থা। এক জনের অর্থনৈতিক শ্রেণিগত অবস্থানের চাইতেও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে সে কোন দল করে। পার্টি শ্রেণি-চেতনা বিকাশের পরিবর্তে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। দরিদ্র মানুষ অন্য দল করলেই তাঁকে অস্পৃশ্য জ্ঞান করা হয়েছে। ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সহমর্মিতার হাত। ফলে সরে গেছে জনভিত্তিও। নেতৃত্বে জাঁকিয়ে বসেছেন মধ্যবিত্ত সুবিধাভোগী তথাকথিত ভদ্রজনেরা।’ নেতা মন দিয়ে শুনলেন। আপত্তি করলেন না।

মনে হল, হয়তো আত্মসমালোচনার একটা প্রক্রিয়া তাঁর অন্তরে চলছে। নতুন পথ খুঁজে নেওয়ার জন্য এই প্রক্রিয়া অত্যাবশ্যক। চিন্তার জগতে তো আর শাসক নেই। সেখানে অপার ব্যক্তিগত নৈরাজ্য। মনের দরজা-জানলা খুলে রাখলে সেই নেই-রাজ্যে অর্বাচীন ধুলোময়লার সঙ্গে দু-চারটে মণিমুক্তোও মিলতে পারে। খুঁজে নেওয়াটা জহুরির কাজ। কঠিন ও বহুমাত্রিক।

অথচ জীবনে বহুমাত্রিকতার কোনও পরিসর নেই। শহর জুড়ে এক বিচিত্র মিছিল। ‘হম সব চোর হ্যায়!’ হাস্যকর। প্রতিবাদ করে কেউ বলছেন পুরো শাসক দলটাই নাকি আপাদমস্তক সমাজবিরোধীদের দল। ‘গুন্ডাশাহি’র চরমতম নিদর্শন। হাস্যকর। উভয়ের মনোভাব পরস্পরবিরোধী হলেও আপাতভাবে এক সূত্রেই বাঁধা। অর্থাৎ, সর্বদাই একটি সামগ্রিক সত্তাকে হাজির করার চেষ্টা। দলীয় নিগড়ে এক-কণ্ঠ হয়ে ওঠা। প্রশ্নহীন, বিতর্কহীন অ-সম্ভব একমাত্রিক আনুগত্যই আমাদের পরিচিত রাজনীতির অভিজ্ঞান।

অতএব ‘মন চলো নিজ নিকেতনে’। ব্যবহারিক প্রয়োগে তার দেখা না-ই মিলতে পারে, কিন্তু মনোজগতে নিজের সঙ্গে নিজের ঝগড়া আছে, দ্বিধা আছে। রাজনৈতিক গণতন্ত্র দলভিত্তিক। কিন্তু দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র কোথায়? কেন সবাইকে একই রঙে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়? এ ক্ষেত্রে বামপন্থীদের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাঁরা শুধুমাত্র বাঁধাধরা রাজনীতির কারবারি নন। তাঁদের দাবি অনুযায়ী সমাজব্যবস্থার (না কি ‘বাস্তবতা’) আমূল পরিবর্তন সাধন কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ, সমাজকে ব্যাখ্যার দায়ও তাঁদের রয়েছে। এখন সমস্যা হল, কোন বিমূর্তায়নের পথ ধরে সেই ব্যাখ্যায় পৌঁছনো যাবে। তাত্ত্বিক ভাবে শ্রেণিকে গুরুত্ব দিলেও বাস্তবে দল অধিকতর মূল্যবান হয়ে উঠেছে। সঙ্গে ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র অমোঘ শৃঙ্খলা।

পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ শাসনের ফলে বামপন্থী কর্মী-সমর্থক-নেতৃবৃন্দের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল যে, দলের বাইরে বৃহত্তর সমাজ ‘আমাদের’ প্রতিপক্ষ। দলের প্রাধান্য বিস্তারেই ‘আমাদের’ জয়। তার সংকোচনে ‘আমরা’ বিপর্যস্ত। সেই জন্য যে কোনও মূল্যে দলীয় আধিপত্য রক্ষা করতে হবে। সমাজ-বাস্তবতার পরিবর্তন দূরের কথা, বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন নেই। দলীয় শুদ্ধিকরণের একটি প্রক্রিয়া আছে বটে, তা দলের মত ও পথ বদলের সাপেক্ষে নয়। প্রশ্নহীন আনুগত্যের নেপথ্যে ধান্দাগুলিকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে নয়। একান্তই দলীয় শৃঙ্খলা ও ভাবমূর্তির প্রয়োজনে।

তাতেও কি শেষ রক্ষা হল? চোখের সামনে দেখতে পাই, অতীতে যাঁরা লাল পতাকা-হাতে ব্রিগেড দাপাতেন, অধুনা তাঁরা অনেকেই তৃণমূলের ছত্রছায়ায়। গরিব মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। জনগণকে টাইট দিয়েও কিছু হবে না। মধ্যবিত্ত সুবিধাভোগী শ্রেণিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে। এঁরাই সামাজিক পরিসরে রাজনীতির মুখ। তুচ্ছ পাওনাগন্ডার অভিপ্রায়ে আজ এ-দল কাল ও-দল করেন। এঁরা বামপন্থীদের ডুবিয়েছেন। এঁরাই তৃণমূলকে ডোবাবেন। সমাজবিরোধীদের আমরা চিনি। তাদের বিচ্ছিন্ন করার প্রয়োজন বহুচর্চিত। তা নিয়ে বিশদে গিয়ে লাভ নেই। কিন্তু তকমা-লাগা চেনা মুখ অচেনা কথা বললে বিস্মিত হতে হয়।

অনেকেই বলছেন বামপন্থীদের নেতৃত্বে বদল আসা উচিত। হয়তো বা। কিন্তু প্রশ্ন তো নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের নিয়ে নয়, নেতৃত্বের ধরন নিয়ে। একই কথা নতুন লোকেদের দিয়ে বলিয়ে কোনও লাভ হবে না। প্রয়োজন নতুন কথা বলা। পরিবর্তনশীল সমাজজীবনের সঙ্গে আপন মতাদর্শগত অবস্থানকে সংযুক্ত করা। ঔদ্ধত্য ঝেড়ে ফেলে পার্টিকে জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়া। গরিব, শ্রমজীবী মানুষ তৃণমূল করলে তাঁকে লুম্পেন, সমাজবিরোধী ইত্যাদি বলে নিজের গা বাঁচানোর রাজনীতি করলে সমাজ-বাস্তবতার পরিবর্তন হবে না, নিজেরাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। স্বীকার করতে হবে যে, পশ্চিমবঙ্গের দরিদ্র জনসাধারণের একটা বড় অংশ তৃণমূলকে বামপন্থীদের বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কেন নিয়েছেন সেটা বোঝার জন্য আত্ম-অনুসন্ধান প্রয়োজন। এক কথায় সবাইকে লুম্পেন, সমাজবিরোধী হিসেবে দাগিয়ে দিলে নিজের পবিত্রতা জাহির হয় বটে, জনবিচ্ছিন্নতা দূর হয় না।

এ কথা ঠিক যে, কাঠামোগত ভাবে এ রাজ্যে বামপন্থীরা এখনও সজাগ। নিজেদের পার্টি সম্মেলনের জন্য তাঁরা যথেষ্ট ব্যগ্র। লোকাল, জোনাল, জেলা কমিটিগুলির সম্মেলন হবে। এই সম্পাদক গিয়ে ওই সম্পাদক আসবেন, তার পর রাজ্য সম্মেলনে সর্বভারতীয় নেতারা বক্তৃতা করবেন। পার্টির বাইরের জনসাধারণ সে-সব কিছু বুঝতেই পারবেন না। নেতারা নিজেদের মধ্যে মেলামেশা করবেন। পার্টির জনগণ হলে এক কথা, বাকিরা ব্রাত্য!

কাঠামোসর্বস্বতা ছেড়ে স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আন্দোলনের পথেই বামপন্থার পুনরুজ্জীবন সম্ভব। সে জন্য সকলের কাছে পৌঁছনো দরকার। ‘আঁস্তাকুড়নিবাসী’দের কাছেও। বস্তুত, সেটাই কমিউনিস্টদের কাজ। ওই ‘ডি-ক্লাস্ড’ হওয়া যাকে বলে আর কি! সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমেই যথার্থ গণ-আন্দোলন সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। সেই যোগসূত্র বহুমাত্রিক হওয়া প্রয়োজন। বহুস্বরকে গুরুত্ব দিলে জনবিচ্ছিন্নতা দূর হতে পারে। জনসাধারণ বাঁচার আদর্শ পরিস্থিতি পেলে তাকেই আঁকড়ে ধরবেন। আপন অভিজ্ঞতার আলোকে বামপন্থাকেও বাঁচিয়ে রাখবেন।

এ রাজ্যে বামপন্থা বৃদ্ধ হয়েছে। তার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত হলেও নতুন ডালপালা সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কথিত আছে, বেশি বয়সে মানুষের দ্বিতীয় শৈশব ফিরে আসে। শৈশবের ধর্ম সব কিছুতে আগ্রহ জাগা। সব কিছু পরখ করে দেখা। চলার পথে অকিঞ্চিৎকর নুড়িপাথর পড়ে থাকলে যৌবনের খরতাপ ও মধ্যবয়সের উদাসী চোখে তা খেয়াল হয় না, শিশু ও বৃদ্ধ তার মধ্যেও তাৎপর্য খুঁজে পায়। আগ্রহ নতুন পথের সন্ধান দিতে পারে।

বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editoial udayan bandyopahyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE