অ-সমান গণতন্ত্র। ধারাভি, মুম্বই। ছবি: গেটি ইমেজেস।
গত বছরের ১৪ জুলাই বাবাসাহেব অম্বেডকরের জন্মদিন উপলক্ষে সারা দেশে ছুটি ছিল। ইস্কুল-কলেজ, সরকারি আপিস-কাছারি, ব্যাঙ্ক-ডাকঘর সব বন্ধ। ভাবলাম, উপরি ছুটির দিনটা বেলা অব্দি ঘুম দেব। কিন্তু প্রতিদিনের মতো সেই সাড়ে ছ’টায় কলিং বেলের শব্দ জমাদার ময়লা নিতে এসেছে। ময়লার ব্যাগটা কোনও রকমে তুলে দিয়ে একটু চোখ বুঝেছি, আবার বেল। কাজের মাসি। দরজা খুলে দিয়ে আবার ঘুমোবার চেষ্টা, ফের টুংটাং, এ বার রান্নার মাসি। অর্থাৎ, ঘুমের দফারফা। বাড়িতে সারাইয়ের কাজ চলছিল। ইতিমধ্যেই ধুমধাড়াক্কা শুরু হয়ে গেছে। বারান্দায় বেরিয়ে দেখি মিস্ত্রিরা ভারা বেয়ে আট তলায় উঠে ভাঙাভাঙির কাজ শুরু করে দিয়েছে। ঘুমটা জমল না বলে মনে মনে এদের সবার ওপর খুব রাগ করতে যাব, হঠাৎ খেয়াল হল, এই জমাদার, কাজের মাসি, রান্নার মাসি, রাজমিস্ত্রি— এরা সকলেই সম্ভবত দলিত, পিছিয়ে-পড়া শ্রেণির মানুষ। বাবাসাহেব অম্বেডকর এদের জন্যই সারা জীবন লড়াই করলেন। তাঁর জন্মদিনে এদের কারও ছুটি নেই। শুধু আমরাই, উচ্চবর্ণের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তরা, অম্বেডকরের জন্মদিন পালনের ছুতোয় ছুটি ভোগ করছি।
এটা বিছিন্ন ঘটনা নয়, চার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে সমাজের মাথারা সব কিছু দখল করে নিচ্ছে, সুযোগসুবিধা, বিষয়সম্পদ, সুখ-শান্তি-নিরাপত্তা, এমনকী বাবাসাহেবের জন্মদিন পালনের অধিকারটুকুও। অর্থশাস্ত্রে এই প্রবণতার নাম দেওয়া হয়েছে এলিট ক্যাপচার। নির্বাচনের অশান্ত ঋতুতে এলিট ক্যাপচারের সমস্যাটি বিশেষ করে ভাবায়। হাজার হলেও আমাদের দেশে একটা গণতন্ত্র তো এখনও টিকে আছে। তার কল্যাণে কোটি-কোটি গরিব মানুষ ভোট দিয়ে তাঁদের ইচ্ছে মতো সরকার তৈরি করছেন। যদিও গরিব মানুষরাই সংখ্যায় বেশি, তবু তাঁদের ইচ্ছেগুলো প্রাধান্য পায় না কেন? কেন ১৯৫১ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর তেষট্টি বছর কেটে গেলেও গরিবদের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো এখনও তেমন ভাবে অবয়ব পেল না, সংখ্যালঘু এলিটদের প্রতিপত্তি এক ফোঁটাও কমল না? এটা একটা মস্ত রহস্য।
রহস্য যে শুধু আমাদের গণতন্ত্রেই আছে তা নয়, গণতন্ত্রের পীঠস্থান খাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আছে। বেশ কয়েক বছর হল মার্কিন কোম্পানিরা তাদের নিজের দেশের কলকারখানাগুলো বন্ধ করে দিয়ে অপেক্ষাকৃত গরিব দেশে মেক্সিকোয়, ব্রাজিলে, মালয়েশিয়া-তাইল্যান্ডে— যেখানে শ্রমের দাম কম, কাঁচামাল পাওয়ার সুবিধে, সে সব জায়গায় নতুন কলকারখানা পত্তন করছে। এটা সব থেকে বেশি ঘটেছে মোটরগাড়ি শিল্পে। একদা গাড়ি-শিল্পের রাজধানী ডেট্রয়েট এখন শ্মশান। যে সব দক্ষ শ্রমিক ডেট্রয়েটের গাড়ি কারখানাগুলোতে কাজ করে আমেরিকান মধ্যবিত্তদের সমান আয় করতেন, তাঁরা পেটের দায়ে নামমাত্র মজুরিতে এখন সুপারমার্কেট ইত্যাদি জায়গায় কাজ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। মার্কিন পুঁজি ভিন দেশে পাড়ি দেওয়ার ফলে অবশ্য লাভ হয়েছে সেই সব দেশের, যেখানে নতুন কলকারখানা গড়ে উঠেছে, কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। কিন্তু আরও বেশি লাভ হয়েছে মার্কিন পুঁজিপতিদের। তাঁরা উৎপাদনের খরচ কমিয়ে তাঁদের লাভ বহু গুণ বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন। অর্থাৎ, দেশ থেকে পুঁজি নির্গমনের ফলে এক দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন লক্ষ লক্ষ মার্কিন শ্রমিক, অন্য দিকে লাভবান হয়েছেন হাতে গোনা কিছু পুঁজিপতি এবং শেয়ারহোল্ডার। এর ফলে গত পঁচিশ-তিরিশ বছরে মার্কিন দেশে আর্থিক অসাম্য অসম্ভব রকম বেড়ে গেছে।
আশ্চর্য ব্যাপার হল, রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, কেউই তেমন ভাবে পুঁজির এই বহির্গমনের বিরোধিতা করেনি। অর্থাৎ, ক্ষমতাসীন সরকার লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার বদলে মুষ্টিমেয় কয়েক জন ধনী পুঁজিপতির স্বার্থ রক্ষাই শ্রেয় মনে করেছেন। এবং সেটা করেও ভোটে জিতেছেন। এটা একটা ধাঁধা। ভোটের কথা ভাবলে শ্রমিকদের স্বার্থচিন্তাই স্বাভাবিক ছিল। যেহেতু তাঁরা সংখ্যাগুরু, নির্বাচনে জিততে গেলে তাঁদের সমর্থন জরুরি। বেকারত্বের মরসুমে কী ভাবে শ্রমিকদের সমর্থন আদায় করা সম্ভব হল? গণতন্ত্র কি তা হলে দুর্লভ সংখ্যাগুরুদের বদলে শক্তিশালী সংখ্যালঘুদের স্বার্থই রক্ষা করে?
সংখ্যালঘু পুঁজিপতিদের অনেক টাকা, তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলির ভোটের খরচ অনায়াসেই বহন করতে পারেন। বিনিময়ে দল ক্ষমতায় এলে সরকারি নীতিকে তাঁরা নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগান, দরকার পড়লে প্রভাব খাটিয়ে বদলে দিতে পারেন সরকারি নীতি। এই পর্যন্ত বোঝা শক্ত নয়। যেটা আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যাচ্ছে না, সেটা হল, সেই নীতি শ্রমিকস্বার্থের পরিপন্থী হলে শ্রমিকরা তাকে মেনে নিচ্ছেন কেন?
এখানে ইউরোপের গণতন্ত্র এবং আমেরিকার গণতন্ত্রের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য করা বাঞ্ছনীয়। আমেরিকায় সামাজিক চলিষ্ণুতা, ইংরেজিতে যাকে বলে সোশ্যাল মোবিলিটি, ইউরোপের তুলনায় বেশি। গরিবের ঘরে জন্মেও এক জন মার্কিন নাগরিক খুব স্বাভাবিক ভাবে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার, সচ্ছল হবার স্বপ্ন দেখতে পারেন এবং সেই স্বপ্ন সফল হওয়াও আশ্চর্য নয়। এটাই সেই বহুচর্চিত ‘আমেরিকান ড্রিম’। এই স্বপ্ন এবং তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা আমেরিকার গরিব ভোটারকে ধনীদের প্রতি সহিষ্ণু করে তুলেছে। গরিব ভোটার ভাবছে, ‘আমিও তো এক দিন ধনী হতে পারি, আমি না হতে পারি আমার ছেলে তো হতে পারে, কাজেই আমরা যেখানে পৌঁছতে চাইছি, সেই স্বপ্নের জায়গাটা আকর্ষণীয় থাকলে ক্ষতি কী?’ অর্থাৎ, বলা যেতে পারে, প্রবল অসাম্য সত্ত্বেও এই সামাজিক চলিষ্ণুতা, এই কুটির থেকে প্রাসাদে উন্নীত হবার সম্ভাবনা, আমেরিকান সমাজকে আজও ধরে রেখেছে। এর প্রতিফলন ঘটেছে গরিব ভোটারদের ব্যবহারেও। মুক্ত প্রতিযোগিতা ও খোলা বাজার, যা মার্কিনি পুঁজির বহির্গমনকে সম্ভব করেছে, এবং শ্রমিকদের মেরে পুঁজিপতিদের রাজা করছে, তার প্রতিও গরিব ভোটাররা বিরূপ নন।
তুলনায় ইউরোপের সমাজে এখনও লর্ড-ব্যারনদের প্রতিপত্তি, যা চেষ্টা করে হয় না, জন্মসূত্রে লাভ করতে হয়। অর্থাৎ, এক জন ইউরোপীয় নাগরিক তাঁর জীবনে কত দূর উন্নতি করবেন, সেটা বহুলাংশে নির্ভর করে তিনি কোন ঘরে জন্মেছেন, তার ওপর। এই সামাজিক স্থবিরতার ফলে ধনী ও নির্ধনের মধ্যে একটা স্থায়ী দূরত্ব তৈরি হয়েছে, কাজেই সেখানে রাজনৈতিক দলগুলিকে আলাদা করে গরিবদের জন্য ভাবতে হয়। আমেরিকার তুলনায় ইউরোপের দেশগুলিতে সরকারের কল্যাণমূলক কাজকর্ম অনেক বেশি, শিক্ষা স্বাস্থ্য আবাসন সবেতেই সরকারি হস্তক্ষেপ। বেকার হলে দরাজ সরকারি সাহায্য। সেখানে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের রমরমা। এক কথায়, সেখানকার গণতন্ত্রে তেমন রহস্য নেই, আমজনতা যা চাইছে, সরকার তা-ই দিচ্ছে।
ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রসঙ্গে ফিরি। এখানে মার্কিন দেশের মতো সামাজিক চলিষ্ণুতা নেই। এক বার গরিব হয়ে জন্মালে প্রজন্মের পর প্রজন্ম গরিবই থেকে যেতে হয়। তাই, যে যুক্তি দিয়ে মার্কিনি গণতন্ত্রের রহস্য ব্যাখ্যা করেছি, তা দিয়ে ভারতীয় ধাঁধার হদিশ পাওয়া যাবে না। পক্ষান্তরে, কেউ কেউ বলতেই পারেন, গণতন্ত্রের চাপে বিভিন্ন সময়ের সরকার গরিব মানুষের জন্য কিছু কিছু কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে গরিব মানুষের অবস্থার ক্রমশ উন্নতি ঘটেছে, দারিদ্রের হার কমেছে, অসাম্যও। কাজেই ভারতীয় গণতন্ত্র প্রত্যাশা মতোই কাজ করেছে, এখানেও কোনও ধাঁধা নেই।
স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে যে দারিদ্রের হার কমছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। যোজনা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ১৯৭৩-৭৪ সালে ৫৪.৯ শতাংশ ভারতীয় দারিদ্ররেখার নীচে বাস করতেন। ২০০৪-০৫ সালে সেই অনুপাত কমে হয়েছে ২১.৭ শতাংশ। কিন্তু চিন অথবা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে, যেখানে কখনওই গণতন্ত্র ছিল না, সেখানেও গত পঞ্চাশ-ষাট বছরে দারিদ্র অনেক কমেছে, বস্তুত ভারতের থেকে অনেক বেশি হারেই কমেছে। তাই ভারতে যে দারিদ্র কমেছে, সেটা গণতন্ত্রের চাপেই কমেছে, এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না।
উপরন্তু, যে ভাবেই মাপি না কেন, আমাদের দেশে ধারাবাহিক ভাবে অসাম্য কমার কোনও প্রমাণ তথ্য থেকে পাওয়া যাবে না। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, কখনও অসাম্য বেড়েছে, কখনও কমেছে। তা ছাড়া, এ দেশে পারিবারিক বা ব্যক্তিগত আয়ের কোনও প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তাই অসাম্য মাপা হয় ভোগের তথ্য দিয়ে। একটু ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, ভোগের অসাম্যের তুলনায় আয়ের অসাম্য সর্বদাই বেশি হয়, যেহেতু ধনীরা তাঁদের আয়ের একটা বড় অংশ সঞ্চয় করে থাকেন এবং গরিব মানুষ তাঁর আয়ের প্রায় সবটুকুই খেয়ে ফেলেন। অর্থাৎ, অসাম্যের যে হিসেব সরকারি ভাবে পাওয়া যায়, আসল অসাম্য তার থেকে ঢের বেশি।
মোট কথা, স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতে ধনী-নির্ধন সকলেরই অবস্থার উন্নতি হয়েছে বটে, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিবদের তুলনায় সংখ্যালঘু বড়লোকদের উন্নতি হয়েছে অনেক বেশি। অসাম্য কমানোর যে কাজটা ভারতীয় গণতন্ত্রের করার কথা ছিল, সেটা ঠিক মতো করা হয়নি। নইলে দেশে এখনও কম করেও চব্বিশ-পঁচিশ কোটি গরিব মানুষ বাস করবেন কেন? গণতন্ত্রের রহস্যটা তা হলে থেকেই যাচ্ছে।
এই রহস্যের সম্পূর্ণ সমাধান আমাদের জানা নেই। এটুকু বোঝা যায় যে, গরিব মানুষের অশিক্ষা এবং অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে দশকের পর দশক তাঁদের ভুল বোঝানো হয়েছে এবং এ ব্যাপারে রাজনৈতিক প্রচারের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। স্বভাবতই, প্রচারের টাকাটা আসে ধনীদের পকেট থেকে। যত দিন অশিক্ষা থাকবে, তত দিন এলিট ক্যাপচারও চলবে। স্বাধীনতার পরে নিরক্ষরতা অবশ্যই কমেছে। কিন্তু নিরক্ষরতা আর অশিক্ষা এক জিনিস নয়। সমস্যা হল, অশিক্ষা কমানোর ব্যাপারে এলিটদের উৎসাহ বা স্বার্থ কোনওটাই নেই। তাই ধর্মীয় গোঁড়ামি কিংবা একটি বিশেষ পরিবারের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের আড়াল তুলে গরিব মানুষের আসল চাহিদাগুলোকে সুকৌশলে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে।
কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটে অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy