যাঁহার রাজনীতির বীজমন্ত্র বিরোধীদের ঘরে ছেলে ঢুকাইয়া দেওয়া, তাঁহার নিকট প্রজ্ঞা আশা করা অর্থহীন। অতএব, অনুমান করা চলে, ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থা ‘রোজ ভ্যালি’-র সহিত জড়িত থাকিবার কথা নিজমুখে স্বীকার করিবার পর কী কর্তব্য, কৃষ্ণনগরের সাংসদ তাপস পাল তাহা জানেন না। অর্ধশতাধিক বত্সর পূর্বের ব্রিটিশ সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ওয়র জন প্রোফুমো-র কথাও সম্ভবত তাঁহার কানে কেহ কখনও তোলে নাই। ব্রিটিশ রাজনীতিক প্রোফুমো গত শতকের ষাটের দশকের গোড়ায় এক বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে পড়িয়াছিলেন। তাঁহার সঙ্গিনীর সহিত রুশ সেনাবাহিনীর এক পদস্থ কর্তারও সম্পর্ক ছিল। অভিযোগ উঠিয়াছিল, প্রোফুমোর সঙ্গিনীর মাধ্যমে ব্রিটেনের গোপন নথি সোভিয়েতের হাতে পড়িতেছে। যখন সম্পর্কটি সম্বন্ধে তদন্তকারীরা নিশ্চিত হইলেন, প্রোফুমো পদত্যাগ করেন ও নিজেকে গণপরিসর হইতে সরাইয়া লন। তাহার পর দীর্ঘ তদন্তে প্রমাণিত হয়, প্রোফুমোর মাধ্যমে কোনও তথ্য রাশিয়ায় পৌঁছায় নাই। সব অভিযোগ হইতে তাঁহাকে সসম্মান নিষ্কৃতি দেওয়া হয়। প্রোফুমো কিন্তু আর রাজনীতিতে ফেরেন নাই, সমাজসেবায় জীবন কাটাইয়া দেন। উদাহরণটি স্মরণীয়, কারণ গণপরিসরে কাহারও বিশ্বাসযোগ্যতা লইয়া প্রশ্ন উঠিলে তাঁহার কী কর্তব্য, প্রোফুমো তাহার মাপকাঠি ধার্য করিয়া দিয়াছিলেন। সেই কর্তব্য যে আইন দ্বারা নির্ধারিত হয় না, তাহার চালিকাশক্তি নৈতিকতা, তাহাও প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন।
তাপস পালের পরিস্থিতি জন প্রোফুমোর তুলনায় গুরুতর। তিনি নিজেই স্বীকার করিয়াছেন, রোজ ভ্যালির সহিত তাঁহার আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক ছিল। এই স্বীকারোক্তি অবশ্যই তাঁহার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলির প্রমাণ নহে। তদন্তে তিনিও নির্দোষ প্রমাণিত হইতেই পারেন। কিন্তু, আপাতত তিনি অভিযুক্ত। এক্ষণে নৈতিকতার দাবি, তিনি তাঁহার সমস্ত পদ ত্যাগ করিয়া গণপরিসর হইতে সরিয়া দাঁড়ান। তদন্ত হইতে দিন। শুধু তাপস পাল নহেন, মদন মিত্রের ন্যায় অভিযুক্তদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাঁহাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলি গুরুতর, এবং সেই অভিযোগের কারণেই তাঁহারা জনমানসে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাইয়াছেন। আইনের ফাঁক গলিয়া তাঁহারা পদ আঁকড়াইয়া থাকিতেই পারেন। বিশেষত, তাঁহাদের সর্বাধিনায়িকা সম্ভবত তাহাতেই বিশ্বাসী, অন্তত মদন মিত্রের মন্ত্রিত্ব বিষয়ক তাঁহার সিদ্ধান্ত তেমন সংকেতই দেয়। কিন্তু, ক্ষমতায় থাকিবার, মানুষের প্রতিনিধিত্ব করিবার নৈতিক অধিকার তাঁহাদের আপাতত নাই। স্বেচ্ছায় সরিয়া দাঁড়াইলে মানুষের চোখে তাঁহাদের সম্মান বাড়িবে বই কমিবে না। জন প্রোফুমো বিনা কারণে কিংবদন্তি হন নাই।
তাপস পাল এক জন সাংসদ। মদন মিত্র বিধায়ক, তদুপরি মন্ত্রী। রাজনৈতিক অপব্যবহারে পদগুলি অর্থ হারাইয়াছে, সত্য, কিন্তু পদের গুরুত্ব ভুলিবার নহে। তাঁহারা আইনসভার সদস্য। মানুষ দেশের আইন প্রণয়নের অধিকার তাঁহাদের হাতে তুলিয়া দিয়াছে। তাপস পালরা ভারতভাগ্যবিধাতা। বিধাতাকে পৃথিবীর ঊর্ধ্বে বিরাজ করিতে হয়। আইনপ্রণেতাদের আচরণ যদি নৈতিকতার বিচারে প্রশ্নযোগ্য হয়, তবে গণতান্ত্রিক আইন প্রণয়নের ব্যবস্থাটি তাহার মর্যাদা হারায়। দুর্ভাগ্য, তাপস পালদের লইয়া সেই প্রশ্ন উঠিয়াছে। অতঃপর, আইন-প্রণেতার ভূমিকা হইতে নিজেদের সরাইয়া লওয়া তাঁহাদের নৈতিক কর্তব্য। গণতন্ত্রের প্রতি এইটুকু শ্রদ্ধা মানুষ প্রত্যাশা করিতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy