Advertisement
১৮ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

ব্যক্তিমানুষই এখানে একটা সম্পূর্ণ ভূগোল

এখন এটা প্রায় নেই-রাজ্য। জল নেই, জমি নেই, রাষ্ট্রের তেমন সহানুভূতি নেই। এমনকী যে প্রকৃতি উজাড় করে বাঁচিয়ে রেখেছিল সুন্দরবনকে, এখন সেই প্রকৃতিও কৃপণ। আছে শুধু স্মৃতি, হাহাকার আর অনিশ্চয়তার এক জীবন বা না-জীবন। চার দিকে জল। এক একটা গ্রামে পৌঁছনোর জন্যে পেরোতে হয় দুটো তিনটে চারটে নদী। জলে ভেসে যায় ইট-বাঁধানো রাস্তা। খড়ের ওপর পলিথিন চাপিয়েও গৃহস্থকে বালতি পেতে রাখতে হয়, বর্ষার দিনে। জলে ডোবে ধানখেত, ডোবা, পুকুর। তবু এই যে এত এত বাড়িতে ঘুরছি সমীক্ষার কাজে, কোনও বাড়িতে কেউ জল বাড়িয়ে ধরে না, বলে না, ‘আহা রে, এই রোদে এসেছ, একটু জল খেয়ে ঠান্ডা হও।’ প্রথমটা একটু অবাক লাগে।

জল জল জল, তবু খাওয়ার জন্য নেই। সুন্দরবনে ইন্দ্রপুজো। ছবি: বিশ্বরূপ দত্ত।

জল জল জল, তবু খাওয়ার জন্য নেই। সুন্দরবনে ইন্দ্রপুজো। ছবি: বিশ্বরূপ দত্ত।

স্বাগত নন্দী ও তোয়া বাগচী
শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৩০
Share: Save:

চার দিকে জল। এক একটা গ্রামে পৌঁছনোর জন্যে পেরোতে হয় দুটো তিনটে চারটে নদী। জলে ভেসে যায় ইট-বাঁধানো রাস্তা। খড়ের ওপর পলিথিন চাপিয়েও গৃহস্থকে বালতি পেতে রাখতে হয়, বর্ষার দিনে। জলে ডোবে ধানখেত, ডোবা, পুকুর। তবু এই যে এত এত বাড়িতে ঘুরছি সমীক্ষার কাজে, কোনও বাড়িতে কেউ জল বাড়িয়ে ধরে না, বলে না, ‘আহা রে, এই রোদে এসেছ, একটু জল খেয়ে ঠান্ডা হও।’ প্রথমটা একটু অবাক লাগে। এত যাঁরা অতিথিপরায়ণ, সব বাড়িতেই শুনি ‘খেয়ে যান’, পরমাত্মীয়ের মতো বসান, প্রশ্নের উত্তর দেন, সেখানে লোকে এত জল-কুণ্ঠ কেন?

না হয়ে উপায় নেই বলে। এটা সুন্দরবন। গোসাবা থানা এলাকায় পড়ে। এখানে গ্রামের পর গ্রাম একই ছবি: একটা চাপা কল, অথবা একটা জলের ট্যাঙ্ক আর জলের জন্য দীর্ঘ লাইন। খাবারের চেয়ে খাবার জলের সংকট অনেক তীব্র। খাবারও সহজে মেলে না বরং খাবার জোগাড়ে পদে পদে জীবনের ঝুঁকি। এক মাসও হয়নি সুমনার মা’কে বাঘে টেনে নিয়ে গেছে। সুমনা দশম শ্রেণির ছাত্রী, তার কাঁধে এখন মাতৃহীন সংসারের ভার। ছোট্ট ভাইটা স্কুলে না গিয়ে কোথায় যে খেলে বেড়াচ্ছে, সেটা যেমন একটা দুশ্চিন্তা, তেমনই আরও বড় দুশ্চিন্তা, ‘বাবা কখন ফিরবে’! বাবা গেছেন জঙ্গলে, মাছ-কাঁকড়া ধরতে। যত ক্ষণ না বাড়ি আসেন, তত ক্ষণ সুমনার নিশিদিন কাটে অনিদ্রায়। মা-ও তো ওই ভাবেই গেছে। জঙ্গলের ভিতর নদীর খাড়ি, খাড়িতে মাছ ধরার সময় নিঃসাড়ে হাজির হয় মৃত্যু।

লোকবিশ্বাস বাঘ শুধু নয়, আরও কিছু আছে জঙ্গলের ভিতর। জঙ্গলের নাকি নিজস্ব নিয়মকানুন আছে, সেগুলো মেনে না চললেই সেই সব অজানা বিপদ সারি দিয়ে নেমে আসে। লোকে জানে, জঙ্গল গরম থাকলে সেখানে যেতে নেই। কিন্তু উপায় কী? নিয়মের চেয়ে পেটের টান অনেক বেশি তীব্র। ‘জঙ্গল গরম’ চলতি কথা, ঠিক কোনও মানে আমরা বুঝতে পারি না। এটুকুই শুধু জানা যায় যে, এ বড় বিপদের সময়।

পেটের টানে পুরুষদের নৌকা পাড়ি দেয় নদী থেকে নদ্যন্তরে। তিন দিন-চার দিনও লাগে ফিরতে। আর ঘরে কুপির বাতি জ্বালিয়ে বসে থাকে মাতা ও পত্নী, কন্যা ও পিতা। জীবন ধারণের রসদ নিয়ে ফেরে তারা, আবার কখনও বা কেউ কেউ ফেরেও না, সঙ্গীরা বয়ে নিয়ে আসে নৌকা-ভর্তি হাহাকার।

সবার তো আবাদি জমি নেই। জমি থাকলেও যে নিশ্চিন্তি, তা-ও তো নয়। বছরের পর বছর এত এত লোককে খাবার জুগিয়ে এসেছে এই জঙ্গল আর নদী। প্রকৃতি এখন ক্রমশ সংকুচিতা। তার ঔদার্য চুরি গেছে। আয়লা তো সে দিনের কথা, তার আগে থেকেই জলজঙ্গল কৃপণ থেকে কৃপণতর। অতএব দলে দলে লোকে ভূমি ছেড়ে, নদী ও জঙ্গল ছেড়ে, কলকাতার ফুটপাথে, মুম্বই, দিল্লি, আমদাবাদের আনাচেকানাচে। কিন্তু সবাই তা পারে না। বহু বহু লোক আছে, যারা অনড়। যেমন, সুমনার বাবা কিংবা নিতাইয়ের মামা। বংশপরম্পরায় জঙ্গল তাদের বাঁচিয়েছে, অন্য কাজ তারা শেখেনি। আবার বাইরে কাজ করতে গেছে যারা, তাদের অনেকের মন টেকে না, কারও ক্ষমতা কমে যায়, তারা ফিরে আসে আজন্মের আশ্রয়ে। ‘খেতে পাই না-পাই, যেখানে জন্মেছি, সেখানেই মরব’, কথাটা কতটা প্রতিজ্ঞা, কতটা নিঃসহায়তার অভিব্যক্তি, সেটা সমীক্ষায় ধরা পড়ার বিষয় নয়। তাঁদের মনের গভীরে যে নদী, যে জঙ্গল, মাছ, কাঁকড়া, মধু, তার খবর বাইরের লোকে পেতে পারে না। সে মনের বিচিত্র গড়ন: যে মানুষগুলো মধু সংগ্রহের জন্য জীবন বাজি রেখে বনে ঢোকে, বাঘ-কামঠ, ফরেস্ট গার্ডের যখন তখন ঝাঁপিয়ে পড়ার ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে, তারাই কিন্তু মধু-চাষে অনাগ্রহী। সেই চাষ করে বহিরাগতরা, যাদের বাড়ি মুর্শিদাবাদ, নদিয়া বা অন্য কোথাও। স্থানীয় মানুষ জমির ভাড়া বাবদ কিছু টাকা পায়, কিন্তু নিজেরা চাষ করে অনেক বেশি লাভবান হওয়ার হাতছানিটা তারা এড়িয়ে যায়। হয়তো এ জন্যই যে, বন থেকেই তো মধু সংগ্রহ চলে আসছে বংশপরম্পরায়, অকৃত্রিম প্রকৃতির মাঝে কৃত্রিম মধুর বাক্স তাদের কাছে উদ্ভটই ঠেকে।

সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক। চতুর্দিকে গভীর অসুখ, প্রকৃতি বিবর্ণা হচ্ছে, কার্পণ্যের তলায় চাপা পড়ে যাচ্ছে তার অতীত ঔদার্য। বড় দুঃখের মাঝেও মানুষের কাছে সেই স্মৃতি রোমন্থনই পরমতম সুখ। তাদের জন্য রাষ্ট্র নেই, অথবা তারা রাষ্ট্রের কেউ নয়। তবু রাষ্ট্র তার দীর্ঘ বাহু ছড়িয়ে দেয়, কখনও পঞ্চায়েত, কখনও এমনকী অ-সরকারি সংগঠনের রূপে। তার দেখা মেলে প্রবল প্রতাপশালী বনবিভাগ, জলপুলিশ, স্থানীয়-অস্থানীয় নেতা-ব্যবসায়ী-আমলাদের দৃশ্য-অদৃশ্য সমন্বয়ে।

রাষ্ট্র সম্পূর্ণ নির্বিকার নয়। ছিটেফোঁটা কল্যাণ সে পৌঁছে দেয় তার শাখাপ্রশাখার মধ্য দিয়ে। চমৎকার নিয়ম। তার এক শাখা নিরন্তর কাঁটার ঝাপট মারে, আর এক শাখা থেকে কদাচিৎ ঝরে পড়ে অল্প বদান্যতা। পঞ্চায়েত তেমন একটা শাখা। সে গাছ লাগায়, একশো দিনের কাজের আইনে কয়েক দিনের কাজের ব্যবস্থা করে, লোকের হাতের কাছে তার অবস্থান। এখানকার মানুষের কথায় পঞ্চায়েত অফিস হল অঞ্চল, আর নির্বাচিত সদস্য হলেন পঞ্চায়েত। দফতরটা নৈর্ব্যক্তিক, তার একটা ভৌগোলিক পরিচিতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাটা ঘোর ব্যক্তিনির্ভর, অথবা ব্যক্তিই হয়ে ওঠে ব্যবস্থা এক জন লোক, যিনি মানুষের ভোটে জিতে পঞ্চায়েত সদস্য, তাঁর নামই হয়ে ওঠে ‘পঞ্চায়েত’।

এ ভাবেই রাষ্ট্রের নির্মাণ। আর এ ভাবেই সুখ, দুঃখ, স্মৃতি, বঞ্চনা, বিড়ম্বনা, ঔদার্য, কার্পণ্যের মধ্যে সুন্দরবনের বসবাস: ব্যক্তি-মানুষই এখানে একটা সম্পূর্ণ ভূগোল। রাষ্ট্রীয় নির্দয়তা ও বৃহত্তর সমাজের ঔদাসীন্যের মাঝেই এই সব ভূগোল খুঁজে নেয় পারস্পরিক দয়া, সহযোগ, ভালবাসা। ভাঙা-গড়ার নিরবচ্ছিন্নতায় জেগে থাকে সুন্দরবন।

প্রতীচী ইন্সস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

probondho swagata nandi toya bagchi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE