Advertisement
১৮ মে ২০২৪
প্রবন্ধ

শ্রীরামকৃষ্ণ: এক অত্যাশ্চর্য আবির্ভাব

ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই সময়কালটাই যেন বড় বিভ্রান্তির। ইংরাজি কেতাদুরস্ত শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু ব্যক্তি তাঁদের নিজের মতো করে লড়ে যাচ্ছেন সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কিন্তু সমগ্র সমাজে তার প্রভাব নামমাত্র। কতিপয় অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তি অশিক্ষা এবং সামাজিক বিভেদের সুযোগে তখন হিন্দুধর্মের স্বঘোষিত ‘ত্রাতা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ।

আজ শ্রীরামকৃষ্ণের ১৮০তম জন্মতিথি

আজ শ্রীরামকৃষ্ণের ১৮০তম জন্মতিথি

তাপস বসু
শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই সময়কালটাই যেন বড় বিভ্রান্তির। ইংরাজি কেতাদুরস্ত শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু ব্যক্তি তাঁদের নিজের মতো করে লড়ে যাচ্ছেন সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কিন্তু সমগ্র সমাজে তার প্রভাব নামমাত্র। কতিপয় অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তি অশিক্ষা এবং সামাজিক বিভেদের সুযোগে তখন হিন্দুধর্মের স্বঘোষিত ‘ত্রাতা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ। আদতে ধর্মের নামে যাবতীয় কুসংস্কারের পতাকা উড়িয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা। বেদ-বেদান্ত-উপনিষদ চর্চা চুলোয় গিয়েছে। ওই সমাজপতিদের দৌড় ছিল পাঁজি পর্যন্ত। পাণ্ডিত্য, পরমতসহিষ্ণুতা, হৃদয়ের ঔদার্য— এই গুণগুলোর কোনওটাই ছিল না তাঁদের। সাগর পেরোলে জাতিচ্যুত করা, মেয়েদের শিক্ষাদানে বাধা, বুধবার বেগুন খেলে অক্ষয় নরকবাসের ফতোয়া দেওয়া—এমন সব যাবতীয় ‘অমঙ্গলকর্মেই’ ছিল তাদের যাবতীয় নিষ্ঠা। চরম অরাজকতা ও নৈরাজ্যের এমন পরিবেশেই হুগলির হদ্দ গাঁয়ের এক যুবক মহানগরী কলকাতায় (তখন যে শহর সমগ্র দেশের রাজধানী) এসে কিন্তু বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন বাঙালি চিত্তে।

শ্রীরামকৃষ্ণের ছিল তিনটি মূল অস্ত্র। অকপট সত্যানুরাগ, নিপীড়িত মানুষের প্রতি অকৃপণ প্রেম এবং যুক্তিবাদে আস্থা। সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের যাবতীয় অসঙ্গতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন তিনি, জ্বেলেছিলেন যে প্রাণের প্রদীপ, তা আজও নিবাত নিষ্কম্প। আচারের চোরাবালিতে যে ধর্মের সমাধি ঘটতে চলেছিল, সত্য ও প্রেমের প্রাণোচ্ছল স্রোতোধারায় তাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণই।

শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে ধর্ম কখনওই আচারসর্বস্ব ছিল না। প্রচলিত গড়পড়তা ধর্মাচার্যদের সঙ্গে এখানেই তাঁর প্রভেদ। পরম ঔদার্যে তিনি ভেঙে দিয়েছিলেন ধর্মে ধর্মে বিভেদের খড়ির গণ্ডি। সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে তাই তিনিই বলতে পেরেছিলেন ‘যত মত তত পথ’। এ জন্যই বর্তমানের অস্থির প্রহরে দাঁড়িয়েও শ্রীরামকৃষ্ণচর্চায় মেলে মুক্তিপথের সন্ধান। এই কারণেই প্রতীচ্যের জ্ঞানীগুণীদের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রতিভাত হয়েছেন ‘ফেনোমেনন’ হিসাবে। অলডাস হাক্সলি, ক্রিস্টোফার ইশারউড, আঁদ্রে জিদ, রোম্যঁা রলাঁ, আর্নল্ড টয়েনবিসকলেই বিমুগ্ধ শ্রীরামকৃষ্ণের ভাববিপ্লবে। এঁদের সকলের কাছেই রামকৃষ্ণদেব এক ‘অত্যাশ্চর্য আবির্ভাব’।

রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সর্বস্তরের মানুষের কাছে সে দিন ধর্ম-ধর্মজীবন-ধর্মাচরণের নতুন বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। সুস্থিত জীবনের লক্ষ্যে যা হয়ে উঠেছিল উত্তরণের রাঙা পথ। তা ছিল সমন্বয়ে, উদারতায়, মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্বে সমুজ্জ্বল। দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরের পূজারি ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্ম সাধনায় নিমগ্ন হয়ে গভীর উপলব্ধি নিয়ে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন ধারা-উপধারার ধর্মচর্চায় ডুব দিয়ে একাধারে সমন্বিত ভাবনা থেকেই উচ্চারণ করেছিলেন গড, আল্লাহ্, ভগবান একই সত্যের পারস্পরিক প্রকাশ।

শ্রীরামকৃষ্ণ লোকধর্ম-লোকভাষা-লোকজীবনের উষ্ণতাকে যুক্ত করেছিলেন নাগরিক জীবনে শিক্ষিতজনের বেদান্ত-ধর্ম-দর্শনচর্চিত মনের সঙ্গে। সমন্বয়ের বাতাবরণেই তাঁর এই চরম উপলব্ধি। বেদান্ত ধর্মে নিষ্ণাত শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বভূতে, সর্বজীবে, সর্বস্তরে ‘ভূমা’ অর্থাত্‌ বৃহত্‌ ‘ব্রহ্ম’র উপস্থিতি অনুভব করেছেন। তাই তাঁর কণ্ঠে বিশ্ব শুনেছে, জীবে দয়া নয়, জীবসেবার আহ্বান। ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’ এবং সেই সঙ্গে ‘মাটির প্রতিমায় যদি পুজো হয়, তবে জীবন্ত মানুষে কেন হবে না?’

হবে। অবশ্যই হবে। হয়েছে, আগামী দিনেও হবে। শ্রীরামকৃষ্ণ-নির্দিষ্ট ধর্মচর্চার প্রেক্ষিতেই তা হয়ে চলেছে। সকল ক্ষেত্রেই মানুষের অনিবার উপস্থিতিকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি উদার মানসিকতা ও সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধর্মকে যুক্ত করেছিলেন কর্মের সঙ্গে। ধর্মকে বর্ম রূপে ব্যবহার করেননি। ধর্মকে সমাজের দায় বহন করতে হয়, বিধবার অশ্রুমোচন করতে হয়, নিরন্ন জনের মুখে অন্ন তুলে দিতে হয়, নিরক্ষরকে সাক্ষর করতে হয়, আর্ত-পীড়িতের সেবা করতে হয়। এই অনুভব থেকেই তিনি নিজের হাতে মানুষের সেবা-ত্রাণকাজের সূচনা করেছিলেন, যা সেই শিবজ্ঞানে জীবসেবারই সমতুল। মথুরবাবুর সঙ্গে কাশী যাবার পথে দেওঘরে, রাসমণির জমিদারির অন্তর্গত প্রথমে খুলনা জেলার সাতক্ষীরায়, পরে নদিয়ার কলাইঘাটায় দুর্ভিক্ষ-প্রপীড়িতদের মধ্যে সেই সেবাকাজ প্রত্যক্ষ করা যায়। তাঁর নির্দেশে এই সেবাকাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৭-এ প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃষ্ণ মিশন। আর ১৮৬৬’তে রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল আধ্যাত্মিক নবজাগরণে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করা।

১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অগস্ট শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধি ঘটে। সেই বছরই এর অব্যবহিত পূর্বে কাশীপুর উদ্যানবাটী থেকে কলকাতার দিকে আঙুল তুলে ‘সমস্যায় কিলবিল’ করা মানুষজনেদের দেখিয়ে তাদের দেখভালের দায়িত্ব অর্পণ করে গিয়েছিলেন মা সারদার উপর। ভাবী রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের নেতৃত্বের দায়িত্বও তিনি সেদিন শ্রীমা সারদাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। অজ্ঞান-অচেতন মানুষের চৈতন্য হোক, পূর্ণমাত্রায় সচেতনা আসুক— এই ছিল তাঁর কাঙ্ক্ষিত। তাই কাশীপুরেই ১ জানুয়ারি উপস্থিত গৃহী ভক্তদের লক্ষ করে সংসারী মানুষদের চৈতন্যের অধিকারী হওয়ার আশীর্বাদ জানিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’। এ সবই ছিল তাঁর ধর্মচর্চার অঙ্গীভূত। সেই ধর্মভাবনা ‘বিশেষ জ্ঞান’ থেকে জাত।

দীর্ঘ অবহেলিত অত্যাচারিত নারীদের সসম্মানে সমাজে অধিষ্ঠিত করার বিষয়টি বিশেষ ভাবে গুরুত্ব পেয়েছিল তাঁর কাছে। প্রাচীন ও নব্য হিন্দু সমাজ নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, গণতান্ত্রিক অধিকারকে সেই সময় প্রবল ভাবে অগ্রাহ্য করেছিলেন; ব্রাহ্মসমাজ নারীর শিক্ষা, নারীর আত্মপ্রকাশ স্বীকার করলেও এ বিষয়ে প্রধান উদ্যোগী হয়েছিলেন সাগরপারের সাহেবরাই, এবং অংশত বিদ্যাসাগরমশাই। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ ষোড়শী রূপে উপাসনার মধ্য দিয়ে নারীশক্তির উদ্বোধন, অবহেলার বিপ্রতীপে সম্মানজ্ঞাপন, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ভৈরবীর কাছ থেকে তান্ত্রিক সাধনায় দীক্ষা, গৌরীমাকে নারীদের সংগঠিত করার প্রয়াস, নারীর অধিকারকেই সুচিহ্নিত করে। সাম্প্রতিক কালে নারীর প্রতি তীব্র অসম্মান-অবিচার-অত্যাচার যখন আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠে, তখন আমাদের রামকৃষ্ণ প্রদর্শিত পথে মাতৃভাবের সাধনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। সমাজ পরিবর্তনের ঋত্বিক রূপে তিনি যুবক-যুবতীদের চিহ্নিত করে যান। যুবজীবনের নিরাবৃত সততা-সারল্য-অকৃত্রিমতাকে গুরুত্ব দিয়েই ‘কাঁচা দুধ’-এর বিশুদ্ধতার সঙ্গে তাদের তুলনা টানেন। এদের নিয়েই তো তাঁর পথ চলা শুরু বৃহত্‌ লক্ষ্যে।

সাম্প্রতিক কালে সত্য বিঘ্নিত, বিকৃত, বিস্মৃত। সমাজকে দুরন্ত লোভ-লালসা গ্রাস করেছে। ধর্মান্তরকরণের বিভীষিকা লক্ষ করা যায়। এ সব কিছু থেকে উত্তরণ অবশ্যই সম্ভব শ্রীরামকৃষ্ণ নির্দেশিত পথে, অনুভূত সত্যে ও তাঁর জীবনাচরণের মধ্যে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sri ramakrishna tapas basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE