বাংলার ইতিহাস ঘাঁটিতে গিয়া ঐতিহাসিকরা দেখিয়াছেন, বাংলার কংগ্রেসের নিজস্ব স্বার্থ কী ভাবে বারংবার সর্বভারতীয় কংগ্রেসের চাপের সম্মুখে আত্মাহুতি দিয়াছে। সেই ট্র্যাডিশন, সেই দীর্ঘ ঐতিহাসিক তালিকায় যুক্ত হইল ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসও। সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতা, প্রাক্তন ইউপিএ সরকারের মন্ত্রী কপিল সিব্বলের তৃণমূল কংগ্রেসের হইয়া সুপ্রিম কোর্টে মামলা লড়িবার সিদ্ধান্ত প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের বাহ্যিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করিবার পক্ষে যথেষ্ট। রাজ্য সরকারের বিপরীতে বিরোধী দলগুলির যখন সর্বাধিক সুবিধাজনক পরিস্থিতি, তখন কেন্দ্রীয় বিরোধী নেতার এই পদক্ষেপের ব্যবহারিক অর্থ: রাজ্যে বিরোধিতার রাজনীতি হইতে কংগ্রেসের ঐচ্ছিক অবসর গ্রহণ। মানসিক অর্থটিও কম স্পষ্ট নয়: এই ঐচ্ছিক অবসর রাজ্য কংগ্রেসের নেতাদের ইচ্ছানুসারে নয়, দিল্লির নেতৃত্বের কার্যক্রম দ্বারা নির্ধারিত। সিব্বলের সিদ্ধান্তের পিছনে কেবলই তাঁহার ব্যক্তিগত পেশাদারি স্বার্থ আছে, দলের কোনও ভূমিকাই নাই, এই যুক্তি একেবারেই ফেলনা। রাজ্য স্তরে দলীয় স্বার্থ বিষয়ে দিল্লি কংগ্রেস উদাসীন, তাই এই ডিগবাজি: ইহা বুঝিবার জন্য প্রজ্ঞা লাগে না।
ডিগবাজির আগে অবশ্য প্রদেশ কংগ্রেসের রকমারি আচরণ দেখা হইয়াছে। কংগ্রেসের এক নেতাই সারদা মামলাটি প্রথম দায়ের করিয়া রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে এই গভীর ফাঁদে টানিয়া আনিয়াছিলেন, অথচ সে দিনও কংগ্রেস দলগত ভাবে কোনও ভাবে তাঁহার পাশে দাঁড়াইতে চাহে নাই। বাম নেতাদের একাংশের সমর্থন ছাড়া আবদুল মান্নান মহাশয় সে দিন মামলাটি হয়তো দায়ের করিতেও পারিতেন না। অর্থাত্ এত বড় একটি রাজনৈতিক চাল কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেসের দলগত পদক্ষেপ হইয়া উঠিবার পথ খুঁজিয়া পায় নাই, ব্যক্তিগত উদ্যোগেই সীমাবদ্ধ থাকিয়াছিল। এহ বাহ্য। মামলা দ্রুতবেগে গড়াইবার পরও কংগ্রেস (সিপিআইএম-এর মতোই) নিষ্ক্রিয় নিষ্কম্প থাকিল। আমরা আবার ইহার মধ্যে জড়াই কেন— এই ভাব দিয়া আর যাহাই হউক, রাজনীতি অসম্ভব। রাজনীতির অর্থ, পরিস্থিতির সুযোগ লইয়া মাঠে নামা ও জন-সংযোগ করা, এবং সে কাজটি যথেষ্ট দ্রুত করা। কংগ্রেস দেখাইয়া দিয়াছে, অতি সুবিধাজনক মাঠেও বিরোধিতার রাজনীতির বলটি খেলিতে সে চূড়ান্ত অনিচ্ছুক এবং অপটু। ইহার পিছনে কেবল সর্বভারতীয় নেতৃত্বের অসহযোগ দেখিলে সরলীকরণ হইবে। অপারগতা ও অমনোযোগের প্রতিযোগিতায় রাজ্য দলও দিল্লির সহিত সবেগে পাল্লা দিতে পারে।
ফল? রাজ্যের রাজনীতি অঙ্গনে সারদা কেলেংকারির যাবতীয় রাজনৈতিক ফল কুড়াইতেছে একটিমাত্র দল, ভারতীয় জনতা পার্টি। ভোটের শতাংশ এবং দলীয় সংগঠন, দুইয়ের হিসাবেই যাহারা পশ্চিমবঙ্গে কিছু দিন আগেও নিতান্ত অনুল্লেখযোগ্য ছিল, এ রাজ্যে তাহাদের তড়িত্-উত্থান কোনও জাদুর খেলা নয়, স্পষ্ট ভবিতব্যের লিখন। বিরোধিতার মাঠটি যখন ভিতর হইতেই স্বেচ্ছায় ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে, বহিরাগত আসিয়াই যে সেই শূন্য স্থান পূর্ণ করিবে, ইহা তো পদার্থবিদ্যার প্রাথমিক পাঠ। গত মে মাসের জাতীয় নির্বাচনে বিজেপির কাছে গোহারা পরাজয়ের অপেক্ষা কোনও অংশে ন্যূন নহে পশ্চিমবঙ্গের এই উলটপুরাণ। কংগ্রেসকে হারাইতে বিজেপি-র ঘাম ঝরাইয়া খেলিবার দরকার নাই, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বা স্ট্র্যাটেজি ইত্যাদি গালভারী শব্দের দরকার নাই। গড়ায়মান বলটি নিজের গোলে না ঠেলিয়া অপর পক্ষের গোলের দিকে ঠেলিতে পারিলেই অনায়াসে চ্যাম্পিয়ন হইবার সম্ভাবনা। কপিল সিব্বল একা নহেন, তাঁহার দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গের দলীয় সহকর্মীরা যে সদলবলেই আত্মঘাতী গোল করিতে বিষম পটু!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy