Advertisement
১৩ জুন ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

সবার উপরে

কেহ যত উচ্চ পদেই আসীন হউন না কেন, তাঁহার পদ কখনও এত উচ্চ হইতে পারে না যে তাহা পদাধিকারীকে আইনের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবে।— ইংল্যান্ডের প্রসিদ্ধ বিচারপতি ও আইনবিদ লর্ড ডেনিং আইনের মাহাত্ম্য বুঝাইতে এই ধরনের একটি উক্তি করিয়াছিলেন। সিবিআই ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে ‘কয়লা কেলেঙ্কারি’র তদন্তে অভিযুক্ত হিসাবে ডাকিয়া পাঠানোয় তিনি বলিয়াছেন, তিনি আইনের ঊর্ধ্বে নহেন, আইনের ডাক আসিলে তিনি বিলক্ষণ হাজির হইবেন।

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৫ ০০:২৫
Share: Save:

কেহ যত উচ্চ পদেই আসীন হউন না কেন, তাঁহার পদ কখনও এত উচ্চ হইতে পারে না যে তাহা পদাধিকারীকে আইনের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবে।— ইংল্যান্ডের প্রসিদ্ধ বিচারপতি ও আইনবিদ লর্ড ডেনিং আইনের মাহাত্ম্য বুঝাইতে এই ধরনের একটি উক্তি করিয়াছিলেন। সিবিআই ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে ‘কয়লা কেলেঙ্কারি’র তদন্তে অভিযুক্ত হিসাবে ডাকিয়া পাঠানোয় তিনি বলিয়াছেন, তিনি আইনের ঊর্ধ্বে নহেন, আইনের ডাক আসিলে তিনি বিলক্ষণ হাজির হইবেন। এই প্রতিক্রিয়া অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু ফলিত রাজনীতি তাহা মানিবে কেন? মনমোহন সিংহের দলীয় সহকর্মীরা অভিযোগ করিতেছেন, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সিবিআই যে তদন্তে ইতি টানিতে চাহিয়াছিল, ছয় মাস পর সেই মামলাতেই মনমোহন সিংহকে সমন পাঠানোর মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার গন্ধ প্রবল। কংগ্রেস রাস্তায় নামিয়া পড়িয়াছে। নয়া দিল্লিতে মিছিল, উত্তর প্রদেশে রেল রোকো— মৃতপ্রায় কংগ্রেস সঞ্জীবনীসুধা সন্ধান করিতেছে। কিন্তু, শাসকরা এই মামলাকে কেন্দ্র করিয়া প্রতিহিংসার রাজনীতি করিতেছেন, এমন অভিযোগ করিবার কোনও বাস্তব ভিত্তি এখনও নাই। কয়লাখনি বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগগুলি পরীক্ষা করিয়া দেখিবার জন্য মনমোহন সিংহকে তলব করিবার মধ্যেও কোনও অস্বাভাবিকত্ব নাই।

মনে রাখিতে হইবে, সিবিআই তাঁহাকে ডাকিয়াছে ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নহে, ভূতপূর্ব কয়লা-মন্ত্রী হিসাবে। সিবিআই আদালত জানাইয়াছে, ২০০৫ সালে ওড়িশার তালাবিরা-দুই কয়লাখনিটি হিন্ডালকোর হাতে তুলিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রক ‘অতিসক্রিয়’ হইয়াছিল বলিয়া ভাবিবার যথেষ্ট কারণ আছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে সংস্থাটির অ-স্বাভাবিক লাভও হইয়াছিল। অতএব, বিষয়টির বিস্তারিত তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আদালত মনমোহন সিংহকে দোষী সাব্যস্ত করে নাই। শুধু তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ করিয়াছে। ব্যক্তি মনমোহন সিংহের সততা প্রশ্নাতীত, এই কথাটি তাঁহার প্রবলতম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও অস্বীকার করিবেন না। বস্তুত, বিজেপি নেতৃত্ব কিঞ্চিৎ ঘুরাইয়া এই কথাটি ইতিমধ্যেই বলিয়াছে। সিবিআই-এর তদন্তেও হয়তো তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হইবেন। কিন্তু, প্রশ্ন দায়িত্বের। কয়লার মতো অর্থকরী রাষ্ট্রীয় সম্পদ যাহাতে নয়ছয় না হয়, তাহা নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব কয়লা মন্ত্রকের উপর ন্যস্ত। ২০০৫ সালে মন্ত্রকটি মনমোহন সিংহের হাতেই ছিল। সেই সম্পদের অপব্যবহার লইয়া যখন প্রশ্ন উঠিয়াছে, জবাবদিহির দায় তাঁহার উপরে বর্তায় বইকী। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে কতখানি সৎ, সেই হিসাব তাঁহার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার যুক্তি হইতে পারে না।

মনমোহন সিংহের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে যতগুলি দুর্নীতির অভিযোগ উঠিয়াছে, কয়লাখনি বণ্টন কেলেঙ্কারি যে চরিত্রে অন্যগুলি হইতে ভিন্ন, সিবিআই আদালত তাহা স্পষ্ট করিয়া দিয়াছে। টু-জি কেলেঙ্কারিতে সুপ্রিম কোর্ট জানাইয়াছিল, প্রধানমন্ত্রীর কাজের চরিত্রই এমন যে তাঁহার পক্ষে প্রতিটি বিষয়ের খুঁটিনাটি জানা সম্ভব নহে। যাঁহারা প্রধানমন্ত্রীকে যথেষ্ট তথ্য দেন নাই, দোষ তাঁহাদের। অর্থাৎ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের। যুক্তিটি অকাট্য। এখানেই কয়লা কেলেঙ্কারি আলাদা। ২০০৫ সালে স্বয়ং মনমোহন সিংহই এই দফতরের দায়িত্বে ছিলেন। অতএব, কোনও খনি বণ্টনে দুর্নীতি হইতেছে কি না, সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকা একান্ত ভাবেই তাঁহার দায়িত্ব ছিল। ব্যক্তিগত সততার ঢালে এই দায়িত্ব ঢাকা যাইবে না। সিবিআই তাঁহাকে কয়লামন্ত্রী হিসাবেই নোটিস পাঠাইয়াছে, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নহে। এত দিন জানা ছিল, তিনি অন্যায় সহিয়াছেন। অন্যায় করিয়াছেন কি না, এই দফায় তাহারই পরীক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE