শিলিগুড়ি ও ভবিষ্যৎ
উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রীর দৃঢ় প্রত্যয় যেন বাস্তবায়িত হয়। আসন্ন শিলিগুড়ি ভোটে জনমুক্তি মোর্চা এবং কেপিপি বিজেপি-র সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে পায়ের নীচে জমি খুঁজে পেতে আগ্রহী। বিজেপি-র দার্জিলিং সাংসদের উক্তিতেও এই প্রাসঙ্গিক সমর্থনসূচক আশ্বাস চাপা থাকে না। প্রত্যুত্তরে গৌতম দেবের কটাক্ষ: এই প্রক্রিয়ায় মোর্চা-কেপিপি-র শিলিগুড়িতে ‘ঘাঁটি গাড়ার প্রচেষ্টা’ শিলিগুড়িবাসী রুখে দেবেন। কারণ, বিচ্ছিন্নতাবাদী এই দুই গোষ্ঠীর লক্ষ্য: বঙ্গভঙ্গ (‘শিলিগুড়ির পুরভোটে...’, আবাপ, ১২-৩)।
সর্বজনবিদিত মুখ্যমন্ত্রী বনাম মোর্চা সুপ্রিমোর সখ্য এখন পরোক্ষ কোন্দলে রূপান্তরিত। অতীতের সমস্ত প্রতিশ্রুতির বহর বিস্মৃত হয়ে গুরুঙ্গ এখন শ’তিনেক মোর্চা সমর্থককে নিয়ে যন্তর মন্তরে গোর্খাল্যান্ড আদায়ে ধর্না দিচ্ছেন। তাঁর দাবির বহর ক্রমাগত বাড়ছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত মৌজা (শিলিগুড়ি সংলগ্ন) মোর্চাতে অন্তর্ভুক্তির দাবি। উল্লেখ্য, মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে গঠিত তামাঙ্গ-লেপচা বোর্ড গঠন গুরুঙ্গদের গাত্রদাহের কারণ।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একটা পাল্টা চাপ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। বিজেপি সাংসদও প্রস্তুত ছিলেন শিলিগুড়ি পুরভোটে স্বীয় শক্তি প্রদর্শনের। মোর্চা-কেপিপি তাকে প্রকারান্তরে সুযোগের ক্ষেত্রটা তৈরি করে দিল। কেননা, একক ভাবে ওই দুটি দলের পুরভোট লড়াইয়ে জয়ের মুখ দেখা অলীক কল্পনা।
সংশয়টা এখানেই। এই পত্রলেখকের আজন্ম বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, চাকরির প্রথম দিকটা শিলিগুড়িতে এবং বাড়িও সেখানে। দীর্ঘ দিন কলকাতার নিকট মফস্সলের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও শিলিগুড়ির সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ আছেই। বলতে দ্বিধা নেই, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর কটাক্ষে আশ্বস্ত হতে পারছি না। কারণ?
প্রথমত, শিলিগুড়ি শহরে বেশ কিছু ওয়ার্ডে এখন নেপালিদের সংখ্যাধিক্য। পুরভোটে মোর্চা-বিজেপি-র মেলবন্ধন অবধারিত ভাবেই ভিন্ন দলের প্রার্থীদের এই সব অঞ্চলে গোহারা হারাবে। তার পর? প্রজ্বলিত হবে আলোকবর্তিকা। দাপিয়ে হাঁটবে বিজয় মিছিল। ঘোষিত হবে ‘গোর্খাল্যান্ড’-এর দাবি।
দ্বিতীয়ত, একই রকম ভাবে বৃহত্তর এবং কেন্দ্রীয় শিলিগুড়ির বহু ওয়ার্ড কিছু অ-বাঙালি সম্প্রদায় অধ্যুষিত। কোনও দলীয় ছুতমার্গ ব্যতিরেকেই এদের ভোট পাবে বিজেপি। যাদের ‘গোর্খাল্যান্ড’ দাবি নিয়ে বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। বরং বঙ্গভূমিতে বসবাস করে, সমস্ত সুবিধা আদায় করেও বাঙালিদের প্রতি যাদের আনুকূল্য নেই। বকলমে মোর্চারই জয়গান।
তৃতীয়ত, শহরের অভ্যন্তরে কেপিপি-র অস্তিত্ব দুরবিন পরিমেয়। রাজবংশী সম্প্রদায়ের বসবাস মূলত শহর ঘেঁষা বহির্ভাগে। সংখ্যায় তারা যথেষ্ট। পুরভোটে বিজেপি-র সঙ্গে লড়লে তাদের প্রার্থীও জয়ী হতে পারেন কোনও কোনও ওয়ার্ডে। ফলে, সেই বাংলা ভাগের চিরকালীন দাবি প্রতিষ্ঠিত হবে।
পরিশেষে, একটা ইউটোপিয়ান চিন্তা। এ রকম কি হতে পারে না, বিচ্ছিন্নতাবাদী ধর্মের সুড়সুড়ি দেওয়া দলগুলোকে ঠেকাতে একটা ত্রিদলীয় আঁতাঁত? বামফ্রন্ট-তৃণমূল-কংগ্রেস মিলিত ভাবে? এমন একটা শক্তি যদি পরীক্ষামূলক ভাবে শিলিগুড়ি পুরভোটে আত্মপ্রকাশ করে, তবেই একমাত্র ‘বঙ্গভঙ্গ’ জিগিরকে রুখে দেওয়া সম্ভব। কী ক্ষতি আছে, যদি স্রেফ শিলিগুড়িকে বাঁচাতে একটা রফাসূত্র হয়?
দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রজন্ম এবং তৎপরবর্তী কালে শিলিগুড়িকে হয় জেলা মর্যাদায় উন্নীত করতে হবে নচেৎ শিলিগুড়ি তরাই-ডুয়ার্সের সঙ্গে আগামী গোর্খাল্যান্ডে তকমাভুক্ত হবে।
শিলিগুড়িবাসী কতটুকু ভাবিত এই উদ্বেগে? কেন শিলিগুড়ির বাঙালিয়ানা ক্রমেই বিলুপ্তপ্রায়? না, বিশেষ একটি দলের সমথর্র্ক ভাববেন না এই পত্রলেখককে। যদি প্রলাপ বকে থাকি, মার্জনা করবেন। শুধু আসন্ন পুরভোটের আগে অনুরোধ, শিলিগুড়ির স্বার্থকে বিসর্জন দেবেন না। যে খেলা খেলছেন পর্বত সুপ্রিমো, তাকে প্রতিহত করা জরুরি। তিনি পাহাড়ের স্বরাজ নিয়ে তুষ্ট থাকুন। কেপিপি-কে সঙ্গে নিয়ে সমতলে ‘বাংলা ভাগ’-এর হুঙ্কার জিগির যেন না তোলেন।
এত কথা বলার কারণ এই যে, বিজেপি-মোর্চা-কে পি পি-র মেলবন্ধন আমাদের ভাবাচ্ছে। আতঙ্কিত করছে।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী। কলকাতা-১২৫
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy