Advertisement
০৫ মে ২০২৪

আমেরিকার নেতৃত্বে সিরিয়ায় আঘাত হানল আরব জোট

অবশেষে সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর উপরে আক্রমণ শুরু হল। তবে একা আমেরিকা নয়, মঙ্গলবারের এই অভিযানে আরবের একাধিক দেশও অংশ নিয়েছে। সিরিয়ায় আইএস-এর মূল ঘাঁটি রাক্কা ও তার আশেপাশে আক্রমণ সীমাবদ্ধ ছিল বলে পেন্টাগন সূত্রে জানানো হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, ‘‘এই অভিযান বিশ্বের কাছে পরিষ্কার করে দিল যে এ লড়াই আমেরিকার একার যুদ্ধ নয়।’’

রাকায় মার্কিন হামলার পরে। ছবি: রয়টার্স

রাকায় মার্কিন হামলার পরে। ছবি: রয়টার্স

সংবাদ সংস্থা
শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৪:৩৮
Share: Save:

অবশেষে সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর উপরে আক্রমণ শুরু হল। তবে একা আমেরিকা নয়, মঙ্গলবারের এই অভিযানে আরবের একাধিক দেশও অংশ নিয়েছে। সিরিয়ায় আইএস-এর মূল ঘাঁটি রাক্কা ও তার আশেপাশে আক্রমণ সীমাবদ্ধ ছিল বলে পেন্টাগন সূত্রে জানানো হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, ‘‘এই অভিযান বিশ্বের কাছে পরিষ্কার করে দিল যে এ লড়াই আমেরিকার একার যুদ্ধ নয়।’’

আইএস-কে দমন করতে এ বছরের ৮ অগস্ট থেকে ইরাকে বিমান হামলা শুরু করে আমেরিকা। প্রথম দিকে মূলত আইএস-এর অগ্রগতি ঠেকাতে, সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে (ইয়াজিদি, কুর্দ) এবং মার্কিন সম্পদ ও নাগরিকদের রক্ষার জন্য অভিযান শুরু হয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যেই আইএস-এর বিরুদ্ধে ইরাক ও সিরিয়ায সংখ্যালঘুদের এমনকী সুন্নিদেরও নির্বিচারে হত্যার অভিযোগ ওঠে। হত্যা করা হয় মার্কিন সাংবাদিক জেমস ফোলি, স্টিভেন সটলফ ও ব্রিটিশ ত্রাণকর্মী ডেভিড হাইনেসকেও। শুধু এলাকা দখলই নয়, সামরিক ও আথির্ক ক্ষমতায়ও যে আইএস আগের সব জঙ্গি সংগঠনকে ছাড়িয়ে গিয়েছে তা আমেরিকা স্বীকার করে নেয়। এর পরেই আইএস-কে নিমূর্ল করতে নতুন নীতি ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।

ওবামার নতুন নীতিতে সিরিয়া-সহ ইরাকে নানা জায়গায় আইএস-এর উপরে প্রধানত বিমান হামলা চালানোর পাশাপাশি অন্য দেশকেও সঙ্গে নিয়ে যৌথ অভিযানের কথাও বলা হয়। আমেরিকা প্রথমে আরবের দেশগুলিকে সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা করে। এই উদ্দেশ্যে মার্কিন বিদেশ সচিব জন কেরির আরব সফর করতে শুরু করেন। তুরস্ক ছাড়া প্রায় সব দেশই কোন না কোন ভাবে আমেরিকাকে সাহায্যের আশ্বাস দেয়। এর কিছু দিনের মধ্যেই প্যারিসে, ইরাকে এবং ফ্রান্সের যৌথ উদ্যোগে বিদেশমন্ত্রীদের এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। আইএস বিরোধী বৃহত্তর জোট গড়ে তোলাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন ও আরবের দশটি দেশ-সহ মোট ৪০টি দেশ সেই সম্মেলনে অংশ নেয়। ইরাকে আইএস-কে নির্মূল করার জন্য সামরিক ও আর্থিক নানা ব্যবস্থা গ্রহণে সবাই সম্মত হলেও সিরিয়া নিয়ে মতপার্থক্য থেকেই যায়।

ইরাকে আইএস বিরোধী অভিযানের সময়ে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, সিরিয়ায় আইএস-এর উপরে আঘাত হানতে না পারলে এই অভিযানে সাফল্য মিলবে না। মার্কিন সেনার চিফ অফ স্টাফস জেনারেল মার্টিন ডেম্পসি ইরাকের পাশাপাশি সিরিয়ায় অভিযানের পক্ষে জোর সওয়াল করেছিলেন। কিন্তু ফ্রান্স এর মধ্যেই ইরাকে আইএস-এর উপরে হামলা চালালেও সিরিয়ায় হামলা চালাতে রাজি হয়নি। রাশিয়া এই ধরনের চেষ্টাকে আগ্রাসন আখ্যা দিয়েছিল। রাজি হয়নি ব্রিটেনও। ব্রিটেন আপাতত ইরাকে আইএস-এর উপরে বিমানে নজরদারি চালাচ্ছে।

প্যারিস সম্মেলনে ঐক্যমত্য না আসায় আরবের দেশগুলিকে সঙ্গে নিয়েই এ দিন সিরিয়ায় আইএস বিরোধী অভিযানে নামল আমেরিকা। এ দিনের আক্রমণে সৌদি আরব, জর্ডন, বাহারি‌ন, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি অংশ নিয়েছে। কাতার সরাসরি অংশ না নিলেও এ দিনের অভিযানে নানা ভাবে সাহায্য করেছে। যদিও আরবের কোন কোন দেশ এ অভিযানে অংশ নিয়েছে তা পেন্টাগন সূত্রে স্পষ্ট করে জানানো হয়নি। পেন্টাগন জানিয়েছে, এ দিনের হামলায় যুদ্ধবিমান, বোমারুবিমান, ড্রোন এবং টোমাহক ল্যান্ড ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। আইএস-এর অস্ত্রঘাঁটি, প্রশিক্ষণকেন্দ্র, কম্যান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার-সহ মোট ২০টি জায়গায় হামলা চলেছে। পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগরে মোতায়েন করা মার্কিন রণতরী থেকে টোমাহক ল্যান্ড ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার মধ্যে দিয়ে অভিযান শুরু হয়। এর পরে আমেরিকা-সহ আরব দেশেগুলির যুদ্ধবিমান, বোমারুবিমান, ড্রোন হামলা শুরু করে। এ দিন দুপুর পর্যন্ত অভিযান চলেছে বলে পেন্টাগন সূত্রে জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জে সিরিয়ার প্রতিনিধিকে এই অভিযান সম্পর্কে আগে থেকে জানানো হয় বলে খবরে প্রকাশ। ‘সিরিয়ান অবজার্ভেটরি ফর হিউম্যান রাইট’ জানিয়েছে, রাক্কা ছাড়াও অলেপ্পো, ইডলিব-এও আক্রমণ হয়েছে। আক্রমণ হয়েছে আর এক জঙ্গি সংগঠন ‘নুসরা ফ্রন্ট’-এর উপরেও। আক্রমণে আইএস-এর ২০ জন জঙ্গির প্রাণ গিয়েছে। প্রায় ৯০ মিনিট আক্রমণ স্থায়ী হয়। মার্কিন বিমান আলাদ করে সিরিয়ায় খোরাসান দলের উপরে হামলা করে। মূলত পাকিস্তানের আল-কায়দা সদস্যদের এই দলটি আমেরিকায় আক্রমণ চালানোর ছক কষছিল বলে মার্কিন প্রশাসন সূত্রে খবর। পুরো অভিযানটি মার্কিন সেনার ‘সেন্ট্রাল কম্যান্ড’ পরিচালনা করে।

রাক্কা আইএস-এর মূল ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ইসলামিক স্টেটের রাজধানী হিসিবে রাক্কার নামও ঘোষণা করেছে আইএস জঙ্গিরা। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সময়ে এখানেই আইএস-এর সৃষ্টি হয়। এখান থেকে সিরিয়া ও ইরাকের বিস্তৃত অংশে ছড়িয়ে পড়ে আইএস। মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-র হিসাব অনুযায়ী এখন এই দলে প্রায় ৩১ হাজার সদস্য রয়েছে। এ দিনের আক্রমণ তাই মূল ঘাঁটিতেই আইএস-কে দুর্বল করার একটা চেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে। এই অভিযান চালানোর পাশাপাশি আমেরিকার অন্যতম লক্ষ্য এই সুযোগে যাতে ইরানের শিয়া সরকার, সিরিয়ার বাসার আল-আসাদ এবং লেবাননের শিয়া জঙ্গি সংগঠন হিজবুল্লার শক্তি বৃদ্ধি না পায়। তাই সুন্নি জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর উপরে আঘাত হানার সময়ে সৌদি আরব, জর্ডন, বাহারি‌ন, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো সুন্নি প্রধান দেশকেই সঙ্গে নিয়েছে আমেরিকা। এতে আইএস-ই যে মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র মুসলিম কণ্ঠস্বর নয় তা জানান দেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন মার্কিন প্রশাসন। বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন সিরিয়ার এই অভিযান আমেরিকার বড় কূটনৈতিক সাফল্য। তবে আইএস দমনে ইরানের সাহায্যও চাওয়া হয়েছে। নিউইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের অবিবেশনের ফাঁকে এই নিয়ে ইরানের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে জন কেরির আলোচনাও হয়েছে। যদিও এখনও পর্যন্ত শুধু জর্ডনই এই অভিযানে অংশ নেওয়ার কথা স্বীকার করেছে। জর্ডনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে, তাদের যুদ্ধবিমান অভিযানে অংশ নিয়ে নিরাপদে ফিরে এসেছে। এই অভিযান চলবে বলেও জর্ডন জানিয়েছে।

তবে শুধু বিমান আক্রমণেই আইএস-কে দমন করা সম্ভব কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানিয়েছিলেন, এই অভিযানে কোনও মতে মার্কিন স্থলসেনা ব্যবহার করা হবে না। যদিও জেনারেল ডেম্পসি স্থলসেনা ব্যবহারের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেননি। এখনও পর্যন্ত ঠিক আছে ইরাকে ইরাকি সেনা, শিয়া মিলিশিয়া ও কুর্দ পেশমেরগা যোদ্ধারা আইএস-এর বিরুদ্ধে স্থলপথে অভিযান চালাবে। কিন্তু আক্রমণের পরে রাক্কা থেকে পাওয়া খবরে জানা যাচ্ছে, আক্রমণের আশঙ্কায় আইএস গৃহস্ত বাড়িতে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। ফলে ভবিষ্যতে সিরিয়ায় স্থলপথে অভিযান চালানোর দরকার হয়ে পড়তে পারে। যদিও বাসার-বিরোধী ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’কে এ কাজের জন্য প্রশিক্ষিত করার দায়িত্ব নিয়েছে সৌদি আরব। কিন্তু ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’কে দিয়ে এই কাজ সম্ভব কি না তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে.

এ দিকে আইএস অপহৃত এ দিন ব্রিটিশ নাগরিক জন ক্যান্টলাই-এর আর এক ভিডিও প্রকাশ করেছে। ভিডিও-য় জন আমেরিকা ও ব্রিটেনের মধ্যপ্রাচ্য নীতির প্রবল সমালোচনা করেছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে নতুন কোনও পদক্ষেপ করার আগে সব দিক বিবেচনা করার কথা বলেছেন। না হলে তার পূর্বসূরী জর্জ বুশের মতো তিনিও অন্তহীন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন বলে সতর্ক করা হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

syria
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE