বালির তপন দত্তের খুনের মামলার পরে এ বার দক্ষিণ হাওড়ার বালক যশ লাখোটিয়াকে অপহরণ ও খুনের মামলা। সিআইডি তদন্তে ফের অসন্তোষ প্রকাশ করে ধৃত ব্যক্তিকে বেকসুর খালাসের নির্দেশ দিল হাওড়ার আদালত।
চলতি মাসেই বালির তৃণমূল নেতা তপন দত্ত খুনের ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী ও তথ্য প্রমাণের অভাবে ৫ অভিযুক্তকেই বেকসুর খালাস করে দিয়েছিল হাওড়ার ফাস্ট ট্র্যাক আদালত। মামলার রায় দেওয়ার সময়ে সিআইডি তদন্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন বিচারক। সোমবার হাওড়ার পঞ্চম অতিরিক্ত দায়রা আদালতের বিচারক দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র সাত বছরের যশ লাখোটিয়াকে খুনের অভিযোগে ধৃত সন্তোষ সিংহকে বেকসুর খালাসের নির্দেশ দেন। বিচারক বলেন, “ওই ঘটনার তদন্তে সিআইডির গাফিলতি রয়েছে এবং যে সব সাক্ষ্যপ্রমাণ সিআইডি আদালতে উপস্থিত করেছিল, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।”
২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি লিলুয়ার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সামনে থেকে অপহৃত হয় যশ। দু’দিন পরে ৩১ জানুয়ারি, সরস্বতী পুজোর দিন ফোরশোর রোডে একটি ঝোপের পাশ থেকে যশের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানায়, দুষ্কৃতীরা প্রথমে হাওড়ার মল্লিক ফটক এলাকার জিটি রোডের বাসিন্দা ওই বালকের হাত-পা মুচড়ে ভেঙে দেয়। পরে তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করে ফোরশোর রোডের ঝোপের পাশে ফেলে দিয়ে যায়।
এই ঘটনার তদন্তভার প্রথমে হাওড়া জেলা পুলিশের হাতে থাকলেও পরবর্তীকালে সিআইডি তদন্তের দায়িত্ব পায়। সিআইডি লাখোটিয়া পরিবারের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সন্তোষ সিংহকে সন্দেহের তালিকার এক নম্বরে রেখেছিল। তদন্তকারীদের দাবি, যশকে যে ব্যক্তি স্কুলের সামনে থেকে অপহরণ করে বালকটি তাকে ‘আঙ্কল’ বলে সম্বোধন করছিল। লাখোটিয়াদের পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছিল, যশ একমাত্র সন্তোষকে ওই নামে ডাকত। এই তথ্য হাতে আসার পরে সন্তোষকেই খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করে তদন্ত শুরু করে সিআইডি।
কিন্তু সন্তোষ যশকে খুন করবে কেন, প্রশ্ন ওঠে তা নিয়ে। তদন্তকারীদের বক্তব্য ছিল, এক সময়ে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও ঘটনার কয়েক মাস আগে সন্তোষের সঙ্গে ওই পরিবারের দূরত্ব তৈরি হয়। সূত্রের খবর, সন্তোষের বিরুদ্ধে স্থানীয় এক প্রোমোটারকে খুনের চেষ্টার অভিযোগ ওঠায় লাখোটিয়া পরিবারের লোকজন তাকে এড়িয়ে চলছিলেন সে সময়ে। এলাকায় ‘মাসলম্যান’ হিসেবে পরিচিত সন্তোষের সে কারণে লাখোটিয়াদের বাড়িতে আসা-যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যশের অপহরণের তিন দিন আগে, ২৬ জানুয়ারি সন্তোষ লাখোটিয়াদের বাড়ি এসে যশের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করে। এর পরে দেশের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য মিষ্টি কিনতে লাখোটিয়া পরিবারের দোকানে যায় সন্তোষ। সেখানে মিষ্টির দাম দেওয়া নিয়ে যশের বাবা অনিল লাখোটিয়ার সঙ্গে বাদানুবাদ হয় তার। এর ঠিক তিন দিন পরেই যশ অপহৃত হয়। সন্তোষও হাওড়া ছেড়ে পালিয়ে যায়।
২০১০ সালের ২৬ এপ্রিল যাদবপুর থানা এলাকায় পরিকল্পনা করে ডাকাতির মামলায় সন্তোষ-সহ ৭ জনকে গ্রেফতার করে দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ। সেই মামলায় সন্তোষ জেল হেফাজতে থাকাকালীন তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের কাছে আবেদন করে সিআইডি। আদালত তা মঞ্জুরও করে। জিজ্ঞাসাবাদের পরে সিআইডি আদালতকে জানায়, সন্তোষ খুনের কথা স্বীকার করেছে। এর পরেই আদালতের নির্দেশে সন্তোষকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে সিআইডি।
সিআইডির দাবি, যশকে অপহরণে করে যে জায়গায় রাখা হয়েছিল এবং খুন করা হয়েছিল, গঙ্গার ধারের সেই বন্ধ তেল মিল দেখিয়ে দেয় সন্তোষ। সেখান থেকেই উদ্ধার হয় যশের স্কুলের জামা। তদন্তের সময়ে গোটা ঘটনার ভিডিওগ্রাফি করা হয়। তা দেখানোও হয় আদালতে। প্রায় চার বছর ধরে মামলা চলার পরে সিআইডি তদন্তে অনেক ফাঁক রয়েছে উল্লেখ করে ঘটনায় সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে অভিযুক্ত সন্তোষকে সোমবার বেকসুর খালাসের নির্দেশ দেয় আদালত।
এ ব্যাপারে সরকারি পক্ষের আইনজীবী অরবিন্দ নস্কর বলেন, “আদালতের কাছে যতটা সম্ভব সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করা হয়েছিল। কিন্তু তা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে আদালত জানিয়েছে। তাই আদালত অভিযুক্তকে বেকসুর খালাসের নির্দেশ দিয়েছে।” বিপক্ষের আইনজীবী দিব্যজ্যোতি সিংহরায় বলেন, “এটি ঐতিহাসিক রায়। এক জন নিরাপরাধকে সিআইডি ফাঁসাচ্ছিল। সমস্ত তদন্তটাই কাল্পনিক গল্পে ঠাসা।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy