Advertisement
২২ মে ২০২৪

লাভের অঙ্ক কষা শুরু অরণ্যশহরে

জীবদ্দশায় এমন দৃশ্য দেখলে নির্ঘাৎ ভিরমি খেতেন নরেন হাঁসদা! তাঁর স্ত্রী চুনিবালার দেওয়াল লিখনে নামের আগে শুধু কমরেড শব্দটাই যা নেই। চুনিবালার দেওয়াল লিখন থেকে প্রচারের যাবতীয় দায়িত্ব সামলাচ্ছেন সিপিএমের তাবড় নেতা-কর্মীরা। ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)-এর নেত্রীর নির্বাচনী প্রতীক অবশ্য ফল ভর্তি ঝুড়ি। তবে ঝাড়খণ্ডীদের চিরাচরিত সবুজ রংয়ের পরিবর্তে বেশির ভাগ দেওয়াল লিখনে বাম সমর্থিত প্রার্থী চুনিবালার নাম লেখা হয়েছে লাল রংয়ে।

কিংশুক গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৬ ০১:১৭
Share: Save:

জীবদ্দশায় এমন দৃশ্য দেখলে নির্ঘাৎ ভিরমি খেতেন নরেন হাঁসদা!

তাঁর স্ত্রী চুনিবালার দেওয়াল লিখনে নামের আগে শুধু কমরেড শব্দটাই যা নেই। চুনিবালার দেওয়াল লিখন থেকে প্রচারের যাবতীয় দায়িত্ব সামলাচ্ছেন সিপিএমের তাবড় নেতা-কর্মীরা। ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)-এর নেত্রীর নির্বাচনী প্রতীক অবশ্য ফল ভর্তি ঝুড়ি। তবে ঝাড়খণ্ডীদের চিরাচরিত সবুজ রংয়ের পরিবর্তে বেশির ভাগ দেওয়াল লিখনে বাম সমর্থিত প্রার্থী চুনিবালার নাম লেখা হয়েছে লাল রংয়ে।

ঝাড়গ্রাম আসনটি অসংরক্ষিত। অথচ এই অসংরক্ষিত সাধারণ আসনে এ বারও তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন আদিবাসী উন্নয়নমন্ত্রী সুকুমার হাঁসদা। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সুকুমারবাবুর বিরুদ্ধে এবার বিরোধী রাজনীতির আদিবাসী নেত্রীকেই অস্ত্র করেছে বামেরা। দু’পক্ষই মানছেন, লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। মল্লদেব রাজাদের খাসতালুকে ভোটের সমীকরণ নিয়ে অবশ্য কিছুটা চিন্তায় রয়েছে শাসক দল। যে কারণে খোদ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত জনে-জনে দলের স্থানীয় নেতাদের ফোন করে মন বোঝার চেষ্টা করছেন বলে খবর।

নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)-এর প্রতিষ্ঠাতা নরেনবাবুর মৃত্যুর পরে স্বামীর মতোই সিপিএম বিরোধিতাকে পুঁজি করে জঙ্গলমহলে রাজনীতি করে এসেছেন চুনিবালা। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে বিনপুর আসনে তৃণমূল জোটের নির্দল প্রার্থী চুনিবালা হেরে যান। এরপর চুনিবালাকে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার জন্য শাসকদলের শীর্ষস্তর থেকে বহুবার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন এই নেত্রী। চুনিবালার দলের অভিযোগ, রাজ্যে ক্ষমতার পালা বদলের পর মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্যা এক পুলিশ অফিসারের ধমক-চমকের জেরে ঝাড়খণ্ড পার্টির সিংহভাগ লোকজন শাসক দলে নাম লেখাতে বাধ্য হয়েছেন। যাঁরা দল বদল করেননি তাঁরা চুনিবালার এক সময়ের ছায়াসঙ্গী ভাগবত হাঁসদার মতো জেল খাটছেন।

এই ক’বছরে ঝাড়গ্রাম বিধানসভা এলাকার মধ্যে থাকা লালগড়ের নেতাই কাঁটার অস্বস্তি পিছু ছাড়ছে না বামেদের। দীর্ঘ কয়েক দশকের প্রথা ভেঙে এ বার ঝাড়গ্রাম আসনে সিপিএমের প্রার্থীই নেই। তৃণমূলের যাত্রাভঙ্গ করতে ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ নীতি নিয়েছে সিপিএম। তাই এ বার চুনিবালাদেবীকে ঝাড়গ্রাম আসনে সমর্থন জানাচ্ছে বামেরা। প্রথমে ঝাড়গ্রাম আসনটি কংগ্রেসকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বামেরা। কিন্তু আলোচনা চলাকালীন ঝাড়গ্রামে চুনিবালাকে বামেরা সমর্থন করে বসায় শেষ বেলায় কংগ্রেসও সুব্রত ভট্টাচার্যকে দলীয় প্রার্থী করেছে।

গত বিধানসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থী সুকুমার হাঁসদা সাড়ে ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। সে বার সিপিএম প্রার্থী তথা ঝাড়গ্রামের প্রাক্তন বিধায়ক অমর বসু প্রায় ৩৫ শতাংশ ভোট পান। কিন্তু নির্দল প্রার্থী জনগণের কমিটির জেলবন্দি নেতা ছত্রধর মাহাতো ২০ হাজার ভোট (১২.৮৮%) কেটে নেওয়ায় সুকুমারবাবুর জয় সহজ হয়েছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মন্ত্রী সুকুমারবাবুকে গত বছর পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে আদিবাসী উন্নয়ন দফতরের দায়িত্ব দেন মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নমন্ত্রী থাকাকালীন সুকুমারবাবুর বিরুদ্ধে বহুবিধ দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সম্প্রতি পোস্টার পড়েছিল অরণ্যশহর ঝাড়গ্রামে। অভিযোগ, শাসক দলের কর্মীদের একাংশই ওই পোস্টার দিয়েছিলেন।

সুকুমারবাবু অবশ্য বলছেন, “আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রার্থী। গত সাড়ে চার বছরের বিপুল উন্নয়নের নিরিখে ভোটাররা আমাকে পুনর্নির্বাচিত করবেন।’’ চুনিবালার অবশ্য সাফ কথা, “মানুষ এ বার পরিবর্তনের পরিবর্তন চাইছেন। জনগণের দাবিতেই বামেদের সমর্থনে প্রার্থী হয়েছি।”

গত লোকসভা ভোটে ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফলে সিপিএম প্রার্থীর থেকে ৫৩ হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে ছিল তৃণমূল। ঝাড়গ্রাম বিধানসভায় এ বার ২ লক্ষ ১৩ হাজার ৭৬১ জন ভোটারের মধ্যে ২৫ শতাংশ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের। সার্বিক ভাবে ৫০ হাজার ভোটার আদিবাসী সম্প্রদায়ের। ঝাড়গ্রাম বিধানসভার মধ্যে রয়েছে লালগড় ব্লকের ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ঝাড়গ্রাম ব্লকের চারটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও ঝাড়গ্রাম পুর-এলাকা। গত বিধানসভা ও লোকসভায় এগিয়ে ছিল তৃণমূল। সব পঞ্চায়েতগুলিও তৃণমূলের দখলে। এর মধ্যে লালগড়ের রামগড় ও কাঁটাপাহাড়িতে ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টির পক্ষে কিছু আদিবাসী ভোট রয়েছে।

শেষ মুহূর্তে কংগ্রেস প্রার্থী সুব্রত ভট্টাচার্যের সমর্থনে ভোটের ময়দান থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টির প্রার্থী অসিত খাটুয়া। তবে তাতে চুনিবালারই লাভ হবে বলে মানছেন অনেকে। প্রয়াত নরেন হাঁসদার প্রতি আদিবাসীদের আবেগ প্রশ্নাতীত। সেই সঙ্গে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও অন্তর্ঘাত আর চুনিবালার প্রতি তৃণমূলের একটি অংশের প্রচ্ছন্ন সমর্থন-সব মিলিয়ে অন্য রকম অঙ্কের আভাস পাচ্ছেন বামেরা।

লড়াইয়ের ময়দানে বিজেপি, এসইউসি, আজসু পার্টি ও নির্দল প্রার্থীরাও রয়েছেন। ভোট কাটার চিন্তা রয়েছে। তবে তৃণমূল শিবিরে থাকা প্রাক্তন ঝাড়খণ্ডী কর্মী-সমর্থকদের একটি বড় অংশও চুনিবালার ভরসা বলে মানছেন আদিবাসী নেত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল। সভা-সমাবেশে চুনিবালার দাবি, গত চার বছরে উন্নয়নের নামে পুকুর চুরি আর কাটমানির কারবার হয়েছে। আদিবাসী ছেলেমেয়েদের জন্য একলব্য স্কুলটিতে লটারিতে ভর্তি প্রক্রিয়া তুলে দেওয়া হয়েছে। জেতার পরে গত পাঁচ বছরে জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছেন আদিবাসী মন্ত্রী।

শাসক দলের মন্ত্রীকে হারানো কী এতটাই সহজ? মুচকি হেসে চুনিবালার জবাব, “মানুষ আর মাটির সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। মানুষের মন বুঝতে ভুল হচ্ছে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE