ভোটের দিন ভূতের নেত্যর অভিযোগ আগে বারবারই উঠেছিল। শনিবার প্রকাশিত নারদ-ভিডিওতে পুরমন্ত্রী ববি হাকিমের কথায় রিগিং করে জেতার কথাও খোলাখুলি সামনে এসেছে। সুতরাং সোমবার থেকে শুরু হতে চলাবিধানসভা নির্বাচনেও শাসক দল একই ভাবে রিগিংয়ের চেষ্টা চালাবে কি না, সেই আশঙ্কা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
নারদ ভিডিওর সত্যতা অবশ্য আনন্দবাজারের পক্ষে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু শনিবার তারা যে ‘ববি-গেট কেলেঙ্কারি’র ভিডিও প্রকাশ করেছে, তাতে ববি নিজেই দাবি করছেন, ২০১৪-র লোকসভা ভোটে বীরভূমে ভোট লুঠ করেছিল তৃণমূল। ভিডিওতে পুরমন্ত্রী স্বীকার করছেন যে ভোটের আগের রাতে অনুব্রত মণ্ডলরা বীরভূমের সাড়ে তিনশো বুথে সিপিএমের পোলিং এজেন্টদের ঘরে ঢুকিয়ে ‘সিল’ করে দিয়েছিলেন। তার পর ববির কথায়, ‘‘এক একটি বুথে চারশো সাড়ে চারশো রিগ করলেই দেড় লাখ লিড হয়ে গেল।’’
বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে শতাব্দী রায় জিতেছিলেন ৬৭ হাজার ভোটে। নারদ ভিডিওতে ববি আর ইকবাল আহমেদের কথা অনুয়ায়ী, ওই দেড় লাখ ভোট লুঠ না হলে শতাব্দীর জেতার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। উল্টে ৮০ হাজার ভোটে হেরে যেতেন শতাব্দী। তৃণমূলের রাজ্য নেতৃত্বের তরফে বীরভূমের দায়িত্বে রয়েছেন ফিরহাদ হাকিমই।
শতাব্দী কি এখন নৈতিক দায় নিয়ে সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেবেন?
জবাবে রবিবার শতাব্দী বলেন, ‘‘রিগ করে নয়, পরিশ্রম করে জিতেছি। যা দেখানো হচ্ছে তা গল্প, অবান্তর কথা।’’ ববি নিজে কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে রাজি হননি। অনুব্রত মণ্ডলও দাবি করেন, ‘‘ববি হাকিমের মুখে বসানো কথাগুলো কাল্পনিক। এ সব স্টিং কিছুই না। গত বারে বিরোধীরা এজেন্টই দিতে পারেনি। এ বারেও পারবে না।’’ এক ধাপ এগিয়ে তিনি যোগ করেন, এ বার বুথে-বুথে ‘গুড়-জল-বাতাসা’ থাকবে। তা হলে কমিশনের দাওয়াই? কেষ্টর জবাব, ‘‘কমিশনের দাওয়াই জানি না। আমি আয়ুর্বেদিক দাওয়াই খাই। আমার দাওয়াই সবার আগে।’’
বীরভূমবাসীর অভিজ্ঞতাও বলছে, ২০১৪-র লোকসভা ভোটে বীরভূম ‘নীরব সন্ত্রাস’-এর ম়়ডেল নিয়েছিল। কোনও রকম হিংসা, ‘বোম মারামারি’ ছাড়াই যাবতীয় ভোট জমা হয়েছিল তৃণমূলের বাক্সে।
কী ভাবে? লাভপুর, নানুর, ইলামবাজার বা বোলপুরের বিস্তীর্ণ তল্লাটে বহু ভোটার ভোটই দিতে বেরোতে পারেননি শাসক দলের কর্মীদের ‘তৎপরতায়’। বিরোধী সমর্থক পরিবারগুলিকে চিহ্নিত করে ভোটের আগের দিন বা ভোটের দিন সকালেই বলে দেওয়া হয়, ‘আপনাদের আর ভোট দিতে যাওয়ার দরকার নেই’। সেই শাসানি উপেক্ষা করেও হাতে গোনা যে ক’জন বেরিয়েছিলেন, তাঁদের আর বুথ পর্যন্ত পৌঁছনো হয়নি। মাঝপথেই তৃণমূলের লোকজনেরা ‘হেফাজতে’ নিয়ে তাঁদের বাড়ি ফেরত পাঠায়। ঠিক কতটা হয়েছিল রিগিং, তা স্পষ্ট হয়ে যাবে বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাঁইথিয়া বিধানসভার ২৫০ নম্বর বুথে প্রাপ্ত ভোটের হিসেব দেখলেই। প্রথমটিতে তৃণমূল পেয়েছিল ৭২১ ভোট। বাম-বিজেপি-কংগ্রেস মিলিয়ে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ছিল স্রেফ ১৭! একই ভাবে বোলপুর লোকসভার নানুর বিধানসভা কেন্দ্রের ২২৫ নম্বর বুথের হিসেব আবার বলছে, তৃণমূল পেয়েছিল ৯৪০টি ভোট। বাকি সব বিরোধী মিলে ১৪টি!
এ বার ভোট লুঠের সেই ‘নকশা’ একেবারে ভিডিও মারফত সামনে আসার পর বীরভূমের ভোট পুরোপুরি বাতিল ঘোষণা করার দাবি তুলেছেন বিরোধীরা। নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানানোর পাশাপাশি বামেরা আদালতে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করার কথাও বিবেচনা করছেন।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র টুইটে মন্তব্য করেছেন, ‘‘নগরোন্নয়ন মন্ত্রীকে বলতে দেখা যাচ্ছে যে, কী ভাবে লোকসভা ভোটের সময়ে বীরভূমে রিগিং হয়েছিল। কী ভাবে বড় আকারে জালিয়াতি হয়েছিল, স্বয়ং মন্ত্রীই তার যথেষ্ট প্রমাণ দিয়ে দিয়েছেন! এর পরে নির্বাচন কমিশনের উচিত ওই ভোটকে বাতিল ঘোষণা করা।’’ সূর্যবাবু জানিয়েছেন, দু’বছর আগে লোকসভা ভোটে শাসক দলের বিরুদ্ধে নানা জালিয়াতির অভিযোগ তাঁরা ইতিমধ্যে কমিশনকে জানিয়েছেন। এ বার বিধানসভা ভোটে তৃণমূল যে আরও মরিয়া হয়ে রিগিং করতে চাইবে, সেই সম্ভাবনার কথাও কমিশনকে জানানো হয়েছে। এই ব্যাপারে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদীর দ্বারস্থ হবেন বামেরা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এ দিনই জৈদীকে টেক্সট পাঠিয়েছেন। ববি-গেটের দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি জৈদীকে বলেন, সোমবার জঙ্গলমহলেও এ ভাবেই ভোট লুঠ করার চেষ্টা করবে তৃণমূলের ‘গুণ্ডাবাহিনী’। কমিশনকে তা আটকাতেই হবে।
লোকসভা ভোটে শতাব্দীর বিরুদ্ধে বিজেপি-র প্রার্থী ছিলেন জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটে হেরে যিনি প্রবল হতাশায় ডুবে গিয়েছিলেন। নারদ ফুটেজ দেখে রবিবার জয় বলেন, ‘‘তখনই বলেছিলাম জোর করে জিতেছিলেন শতাব্দী, মানুষের ভোটে জেতেননি। এই ফুটেজ নিয়ে আমিও আদালতের কাছে যাব।’’
ঘটনা হল, দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেমন ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকা রয়েছে, তেমনই বীরভূম সব থেকে রিগিং প্রবণ এলাকা। গত লোকসভা ভোটে রিগিংয়ের এপিসেন্টার ছিল অনুব্রত-মনিরুল ধন্য এই জেলা। তৃণমূলের নেতারাই স্বীকার করছেন, বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া এবং মেদিনীপুরের একাংশ নিয়ে মধ্যবঙ্গে কমবেশি যে ৯৯টি আসন রয়েছে, রিগিংয়ের জন্য সেটাই মূলত তাঁদের টার্গেট এরিয়া। এই এলাকার প্রতিটি বুথ ধরে ধরে মাপজোপ করে রাখা রয়েছে। দিদি-র লক্ষ্য, যত বেশি সম্ভব আসন মধ্যবঙ্গের এই এলাকা থেকে জিতিয়ে আনা।
গত বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস-তৃণমূলের জোট ছিল। বীরভূমের ১১টি বিধানসভার মধ্যে তৃণমূল জোট পেয়েছিল সাতটি আসন। ২০১৪-র ভোটে জোট ছিল না। লোকসভা নির্বাচনে বিধানসভার কেন্দ্রওয়াড়ি ফলাফলে বীরভূমের ১১টি আসনের মধ্যে ন’টিতে জিতেছিল ত়ৃণমূল। এ বার আশা আরও বেশি। অনুব্রত-মনিরুলরা ঘোষণা করে দিয়েছেন, দিদি-কে ১১টার মধ্যে ১১টাই ‘উপহার’ দেবেন।
কদিন আগে অনুব্রত খোলাখুলিই সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ভোটের আগের রাতে তিনি প্রতিটি কেন্দ্র ধরে ধরে কর্মীদের সঙ্গে মিটিং করবেন। ঠিক যেমন আগের ভোটে করেছিলেন। কোথাও রাত ন’টায় যাবেন তো কোথাও রাত বারোটায়। কী বলবেন কর্মীদের? জবাবে অনুব্রত বলেছিলেন, ‘‘সেটা কানে কানে বলব খোলাখুলি নয়। তবে হ্যাঁ প্রতিটা বিধানসভা আসনে পঞ্চাশ হাজারের লিড চাই-ই চাই, তা বলে দিয়েছি।’’ ওই লিড দেওয়াতে না পারলে দল থেকে বাদ দেওয়ার হুমকিও দিয়ে রেখেছেন কেষ্ট। আর বারবারই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘ভোট কী করে করাতে হয় আপনারা জানেন! সিপিএম যে ভাবে ভোট করত, আমরাও সেটাই করব!’’
নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী যতই নিশ্চিন্ত ভোট হওয়ার আশ্বাস দিন না কেন, রিগিংয়ের ভয় কিন্তু বাড়ছেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy