Advertisement
০২ মে ২০২৪
স্লোগানে তাঁদের কথা নেই। ইস্তাহারে তাঁদের স্বার্থ দেখে না কেউ। তাই আজও গ্রামছাড়া
West Bengal Assembly Election 2021

bengal polls: বিতাড়িত পরিবারের কথা এখন ভাবে কে

আট মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ফিরতে পারেননি তাঁরা। ভোটের আবহে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হলেও, আড়ালে থেকে গিয়েছে মণিকুণ্ডতলা।

সেই তিন জন। সুভাষ মুর্মু, সোনা মুর্মু ও সুদীপা সোরেন।

সেই তিন জন। সুভাষ মুর্মু, সোনা মুর্মু ও সুদীপা সোরেন। নিজস্ব চিত্র।

সোমা মুখোপাধ্যায়
বোলপুর শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২১ ০৫:৫৯
Share: Save:

মণিকুণ্ডতলা গ্রাম কোন দিকে?

বোলপুর স্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে সিয়ান-মুলুক পঞ্চায়েতের যদিও বা হদিশ পাওয়া গিয়েছিল, মণিকু্ণ্ডতলা গ্রামের কথা কেউ বলতে পারছিলেন না। ওই যে সেই গ্রাম, যেখানে ডাইনি অপবাদে কয়েক জনকে....। এ বার কথা শেষ না-হতেই দূরে আঙুল দেখান কেউ কেউ। কেউ আবার ভয়ার্ত মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকেন। খোঁজাখুঁজির পরে গ্রামে পৌঁছেও একই অবস্থা। বিষয়টি নিয়ে প্রথমে মুখ খুলতে চাননি কেউ। অথচ গত জুলাইয়ে এক বৃষ্টির রাতে এই গ্রাম থেকেই ডাইনি অপবাদে তাড়ানো হয়েছিল এক পরিবারের ১৩ জনকে। আট মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ফিরতে পারেননি তাঁরা। ভোটের আবহে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হলেও, আড়ালে থেকে গিয়েছে মণিকুণ্ডতলা।

জেলা প্রশাসনের তরফে আশ্বাস, যত দ্রুত সম্ভব ওই পরিবারকে ঘরে ফেরানো হবে। কিন্তু প্রশাসনের তরফে যদি ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা হয়ও, তাঁদের মেনে নিতে কতটা প্রস্তুত গ্রাম? কতটা অন্ধ বিশ্বাস আর কুসংস্কার ২০২১ সালেও মানুষকে এ ভাবে ভাবতে বাধ্য করতে পারে? তা দেখতেই মণিকুণ্ডতলা যাওয়া। আদিবাসী গ্রামটিতে ঢোকার মুখেই লাঠি হাতে যে বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা, তিনি কারণটা জেনে স্পষ্ট বলে দিলেন, গ্রামে আর কোনও উটকো ঝামেলা চান না তাঁরা। জানালেন, সব ‘আপদ-বিপদ’ কেটে গিয়ে এখন স্বস্তিতে আছেন! আর যেন তাঁদের উত্যক্ত করা না হয়।

‘বিপদ-আপদটা’ ঠিক কী? দাবি, গত বছরের মাঝামাঝি গ্রামে অসুখবিসুখ হচ্ছিল অনেকের। মারা যাচ্ছিল বাড়ির গরু-ছাগল। আচমকা গ্রামবাসীদের মনে হতে থাকে, এর পিছনে রয়েছে গ্রামেরই এক পরিবার। ডাকা হয় ওঝা। ঝাড়ফুঁক করে ওঝা দাবি করে, গ্রামেই রয়েছে এক ‘ডাইনি’। মধ্য পঞ্চাশের এক মহিলার নাম করে দাগিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সেই খবর। গ্রামের মোড়লের নেতৃত্বে বসে সালিশি সভা। সেখানে স্থির হয়, পরিবার সমেত গ্রাম ছাড়তে হবে ওই মহিলাকে। রাতেই পরিবারকে ডেকে সেই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হলেও, তাঁরা রাজি হননি সব ছেড়েছুড়ে এ ভাবে চলে যেতে। অভিযোগ, এর পরে গ্রামবাসীরা একত্রিত হয়ে চড়াও হয় ওই পরিবারের ওপরে। চলে বেধড়ক মারধর। প্রাণে বাঁচতে পাঁচটি শিশু নিয়ে রাতেই বাড়ি ছাড়ে ১৩ জনের ওই পরিবার। এখনও ফেরা হয়নি।

সে দিন রাতের ওই আক্রমণে যাদের মুখ্য ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ, তাদেরই অন্যতম এক প্রৌঢ়ের কথায়, ‘‘রাতে গ্রামের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ত, ওই মহিলা তখন পুজো করত। গোটা গ্রামকেই শেষ করে দিতে চেয়েছিল ওরা।’’ বৃদ্ধের প্রতিবেশী মধ্য ত্রিশের এক তরুণীর দাবি, ‘‘রক্ত মাখা ফুল-পাতা ছ়ড়িয়ে দিত গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির সামনে। ওই পরিবার আগে যে গ্রামে থাকত, সেখানেও এমন করেছে।’’

কে দেখেছেন রক্ত-মাখা ফুলপাতা ছড়াতে? ফুল-পাতায় যে রক্তই মাখানো ছিল, সেটা কী ভাবে জানা গেল? আগে কোন গ্রামে থাকত ওই পরিবার? কে বলেছেন আগের গ্রামের সমস্যার কথা? একটি প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারেননি কেউ। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন শুধু।

কথা চলার ফাঁকে নজর গেল অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা তিন জনের দিকে। বয়স ৮ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। বাড়ির বড়রা যখন বার বার তাদের বাড়ির ভিতরে ঢুকতে বলছেন, তারা ঠায় দাঁড়িয়ে। বিতাড়িত পরিবারটির ঘর কোথায় জানতে চাইলে গ্রামের বড়রা যখন অন্য দিকে তাকিয়ে থেকেছেন, তখন ওই তিন জনই এগিয়ে এসেছে বাড়ি চেনানোর জন্য। সুদীপা সোরেন, সোনা মুর্মু আর সুভাষ মুর্মু। সুদীপা এবং সোনা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। সুভাষ পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। তোমরা জানো তো কী হয়েছিল? বিতাড়িত পরিবারের তালাবন্ধ ঘর, ভাঙাচোরা গৃহস্থালির মধ্যে চরম অযত্নেও ফুল ধরেছে গাছে। টকটকে লাল সেই ফুলের দিকে তাকিয়ে সুদীপা বলে, ‘‘সবটাই জানি। আমরা তো চাই ওরা ফিরে আসুক।’’ কেন? সোনা আর সুভাষ বলে ওঠে, ‘‘কেন আসবে না? ডাইনি বলে কিছু হয় নাকি?’’ কী করে জানলে? তিন জনেই প্রায় সমস্বরে বলে ওঠে, ‘‘আমরা তো লেখাপড়া করি। আমরা জানি এ সব ভুল।’’ সেটা কাউকে বলোনি? ‘‘কেউ শোনেনি আমাদের কথা’’— বলার সময়ে তিন কচি মুখেই ধরা পড়েছে রাগ আর হতাশা।

কিন্তু ওই তিনটে মুখই নিমেষে বদলে দিয়েছে মণিকুণ্ডতলাকে ঘিরে যাবতীয় নেতিবাচক ভাবনার আবহ। ওরা বা ওদের মতো ভবিষ্যৎ নাগরিকদের নিয়ে কেন সচেতনতা কর্মসূচির ব্যবস্থা করছে না প্রশাসন? ওই তিন জনকে প্রচারের মুখ হিসেবে তুলে ধরেও তো লড়াই করা যায় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে!

জেলা প্রশাসনের তরফে কেন সেই চেষ্টা চালানো হয়নি? শুধু পুলিশ দিয়ে জোর করে পরিবারকে গ্রামে ফেরালে কি সমস্যা মিটবে? জেলা প্রশাসনের এক কর্তাকে এই প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, ‘‘আগে ভোটটা মিটুক। তার পরে ও সব ভাবা যাবে। এখন একটা গ্রামকে নিয়ে ভাবার ফুরসত কই?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bolpur West Bengal Assembly Election 2021 witch
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE