মেদিনীপুরে প্রচারে জুন মালিয়া। নিজস্ব চিত্র
সাত-সকালে প্রার্থীর প্রাতরাশের সময়েও ফ্ল্যাটে মেজ-সেজ নেতাদের ভিড়। কথা বলতে বলতেই ফ্রিজ থেকে দইয়ের ভাঁড়টা এনে চিঁড়েয় মেখে ঝটপট খাচ্ছেন তিনি। খেয়ে নিজেই বাটিটা রান্নাঘরে রেখে এলেন।
একটু বাদেই শহরের উপকণ্ঠে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ে মাওবাদী হামলাস্থল ভাদুতলায় খোলা জিপে দেখা গেল তাঁকে। চৈত্রের চড়া রোদে রোড-শোয়ে দাঁড়িয়েও ‘স্বাবলম্বী’ অভিনেত্রী। নিজের ব্যাগ নিজে বইছেন। আর একটা হাত জিপের বাইরে এলানো সমানে ছুটতে থাকা মেয়ে-বৌদের জন্য। টানাটানিতে সিঁদুর লেগে হাত লাল। জিপ থামলে মেয়েরা জাপ্টে ধরছেন। সোনাকড়া গ্রামের খেতমজুর প্রৌঢ়ও শুনিয়ে যাচ্ছেন, “দিদি তুমি গ্রামের উন্নতি করবে ভাল কথা! কিন্তু ‘সাঁঝের বাতি’ সিরিয়ালটা যে সন্ধ্যার টাইম পাল্টে বিকেলে করা হল, মাঠের কাজ ফেলে, আমরা দেখব কখন?”
সিরিয়ালে ‘আর্যর মা’, মেদিনীপুর কেন্দ্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্নেহধন্যা’ প্রার্থী জুন মালিয়া তবু জানেন, এই ভোট-যাত্রা তাঁর কাছে গোলাপ-বিছানো পথ নয়। সন্ধ্যায় বটতলার ‘স্ট্রিট কর্নারে’ ‘খেলা হবে’ হাঁক দিলেও একান্তে বলছিলেন, “এটা সিরিয়াস বিজনেস! বোধহয় ব্যারাকপুর আর আমারটাই অ্যাক্টরদের সিটগুলোর মধ্যে টাফেস্ট। আমি খুব খুশি কঠিন লড়াইয়ে দিদি আমার উপরেই ভরসা রেখেছেন।”
সকালে প্রার্থীর রোড-শোয়ের আগে শাসক দলের জেলা নেতা সুজয় হাজরাও মুক্তকণ্ঠ, “উনি প্রথম দিন থেকেই আমাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন। দারুণ জোশ! কোনও কিছু নিয়ে মনে অভিমান নেই। বক্তৃতার থ্রোয়িংটাও সুন্দর!” সুজয়বাবু নিজেও এই কেন্দ্রে প্রার্থীপদের দাবিদার ছিলেন। বলছেন, “খুচখাচ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে এর থেকে ভাল প্রার্থী হতো না!”
প্রার্থী অবশ্য জুন ২০১১তেও হতে পারতেন। প্রস্তাবও ছিল। তখন সোহম, হরনাথ চক্রবর্তীদের সঙ্গে লক্ষ্মণ শেঠের গড়ে নিজেদের গাড়িতে প্রচার-স্মৃতি মনে পড়ে আজকের প্রার্থীর। বলছেন, “তখন তো একটা পুঁচকে ছানাও দিদির নামে জিতত। কিন্তু ভোটে দাঁড়ানোর মতো তৈরি তখন হইনি। বাংলার রাজনীতির একটা কঠিন সময়ে দিদির কাজে লাগতে পারছি, এটাই ভাল হল!”
জীবনে কোনওকিছুর জন্য তাড়াহুড়ো না-করার দর্শনটাও কাজে এসেছে, বলছেন জুন। “জানেন, দ্বিতীয় বার বিয়ের আগেও আমি ১৬ বছর ডেট করেছিলাম। আমার ভোটে দাঁড়ানো নিয়েও সেই কবে থেকে জল্পনা!” বর এখন কলকাতায় জুনের মা, মেয়ের দেখভাল করছেন। এবং দুই কুকুর-সন্তান ব্রুনো-ডিয়েগোকে সামলাচ্ছেন। হবু পাইলট যুবকপুত্র, দু-এক জন সুহৃদকে নিয়ে জুন মেদিনীপুর টাউনের পাটনাবাজারে স্থানীয় নেতা বিশু পান্ডবের শ্বশুরবাড়ির ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে রাত একটার ব্যস্ত রোজনামচা। দুপুরে ঘুমের প্রশ্ন নেই। ১২-১৪ ঘণ্টার প্রচার। রংচটা ধূলি-ধূসর চটিতে গ্রামে হাঁটছেন। কর্ননগরে প্রচার-সঙ্গীর হাতের ওআরএসের বোতল ফিরিয়ে নিলেন। বনমাতার মন্দিরের প্রসাদী পেঁড়া টপ করে মুখে পুরলেন। সগর্বে বলছেন, “পার্টির সিনিয়র নেতারা পাশে আছেন। পিকের টিমের ছোটদের আমি মাদার ফিগার!”
স্থানীয় নেতাদের অস্বস্তি ছিল! তবু কোড়দানা গ্রামের হাড়জিরজিরে বৃদ্ধা বিধুদেবীর জলের কষ্ট শুনতে বাড়ির ভিতরেও ঢুকলেন জুন। কয়েক জনের ফোন নম্বরও টুকে নিতে বললেন সঙ্গীদের। শহরের সান্ধ্য সভায় জুনের ঘোষণা, “আপনাদের সোনার কেল্লা দিতে পারব না, কলে জলটুকু নিশ্চয়ই দেব! যুবদের কর্মসংস্থানের জন্যও দিদি আর আমি খুব চেষ্টা করব।”
তিনি যে জেলারই মহিষাদলের রাজবাড়ির মেয়ে পদে পদে সেই প্রচার চলছে। নিয়ম করে বলছেন, “অভিনেত্রী নই! আমি আপনাদের মাটির মেয়ে!” জেতার পরে সপ্তাহে দু’দিন মেদিনীপুরে থাকার আশ্বাসও দিচ্ছেন। শহরের গলিতে স্কুটিতে ঘুরছেন। সব সময়ে সুতির শাড়ির সাজ। জুনের অবশ্য দাবি, “গ্রামের লোক জিনসেও কিছু মনে করতেন না। কিন্তু গরমে শাড়িতে মাথা ঢাকার সুবিধাই আসল।” কঠিন কেন্দ্রে কিন্তু হাওয়ায় ভাসে, আগের তারকা সাংসদ সন্ধ্যা রায়ের ‘সহযোগী’দের নিয়ে অভিযোগ। পরিশ্রম, হাসি ও মিষ্টি ব্যবহারে সব নেগেটিভকে পাল্টে দিতে অক্লান্ত চেষ্টা। জুন জানেন, জিতলে শুধু টিভি নয়, রাজনীতির তারকাও তিনি হবেনই হবেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy