সুগার যতই থাক, পায়েস দু’চামচ আপনাকে খেতেই হবে!
শুনে মনে হতে পারে ‘বৈষ্ণব’ অনুরোধ! কিন্তু আদতে প্রচ্ছন্ন হুমকি। দণ্ডমুণ্ডের এই কর্তার নামই সিন্ডিকেট!
শাসক দলের এক সিন্ডিকেট-চাঁই নিজের মুখেই কবুল করলেন, পারতপক্ষে গায়ে হাত তাঁরা দেন না। নিজেদের ভিতরকার ঝামেলা ছাড়া খুন-জখমের পথেও বড় একটা হাঁটেন না। ঠান্ডা গলায় খদ্দেরকে ‘পায়েস’ খেতে বলেন। তাতেই পনেরো আনা কাজ হয়ে যায়। নিতান্তই না হলে একটু আঙুল বাঁকানো। ব্যস!
কলকাতার উপকণ্ঠে নির্মীয়মাণ উপনগরীতে সিন্ডিকেটের দাদা-ভাইদের চোখ এড়িয়ে একটা ইটও যে গাঁথা যাবে না, সেটা সকলেরই জানা। সিন্ডিকেটের এই মার্কামারা চেহারা রাজারহাট-নিউটাউনে যতটা প্রকট, অন্যত্র ততটা হয়তো নয়। কিন্তু রাজ্যের বিভিন্ন শহর ও শহরতলিতে সিন্ডিকেট-রাজ আরও নানা অবতারে হাজির। কোথাও তারা পাড়ার ক্লাব, কোথাও সমবায় সমিতি, কোথাও স্রেফ ছেলের দল, কোথাও আবার ভরসার জোগানদার। কোনও পাড়ায় বাড়ি বানাতে চাইলে, বা বাড়ি বিক্রি করতে চাইলে এই অবতারদের তুষ্ট করা বাধ্যতামূলক। আর ব্যবসা করতে চাইলে তো কথাই নেই। তখন দাদাদের দাবির ভঙ্গি আর চেহারাও বদলে যায়। এঁরা সবাই হয়তো ইট-বালি-সিমেন্ট-পাথর সরবরাহ করেন না। তবে পাড়ায়-পাড়ায় নিজেদের ‘উপস্থিতি’ জাহির করতে ‘ট্যাক্স’ আদায়ে সদা-সক্রিয় থাকেন।
এই সব নিয়েই সিন্ডিকেট। এবং এঁরা অধিকাংশই শাসক দলের সমর্থক বা অনুগামী। কোনও না কোনও নেতার নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছেন। এই চক্রের কোথায় শুরু, কোথায় শেষ— ঠিকানা খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার। নানা রূপে, নানা প্রক্রিয়ায় কখনও নিউটাউন, কখনও কসবা, কখনও শ্যামবাজার, কখনও যাদবপুরে এঁরা ক্রমাগত ফুলেফেঁপে উঠছেন। রাজ্য জুড়ে নানা কিসিমের সিন্ডিকেট-চক্রের হাত ধরে সংগৃহীত টাকা নির্দিষ্ট পথ বেয়ে পৌঁছে যাচ্ছে নির্দিষ্ট হাতে।
কী রকম? নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁদের প্রাথমিক হিসেব বলছে, দিদির রাজত্বে গত পাঁচ বছরে কেবল রাজারহাট-নিউটাউনেই ছোট-বড়-মাঝারি মিলিয়ে মোট এক কোটি বর্গফুট নির্মাণ হয়েছে। নির্মাণ খরচ গড়ে প্রতি বর্গফুট ২ হাজার টাকা হলে মোট খরচ হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। এই নির্মাণ সামগ্রীর বেশির ভাগটাই সরবরাহ করেছে সিন্ডিকেট চক্র। তাদের লাভের পরিমাণ ১৫ শতাংশ ধরলে তৃণমূল আমলে সিন্ডিকেটের পকেটে ঢুকেছে ৩০০ কোটি টাকা। এক সিন্ডিকেট চাঁইয়েরও স্বীকারোক্তি, ‘‘আমাদের আমলে এই এলাকায় সিন্ডিকেটের হাতে মোটের উপর ৩০০ কোটি টাকা এসেছে।’’ অর্থাৎ বছরে ৬০ কোটি টাকা। এর বাইরে শুধু শহর ও শহরতলিতে চলতে থাকা নানা নামের সিন্ডিকেট পাঁচ বছরে আরও অন্তত ৪০০ কোটি টাকা তুলেছে। তার মানে সব মিলিয়ে প্রাপ্তির অঙ্কটা বছরে কমবেশি ১৫০ কোটি টাকা। এবং সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত এক তৃণমূল নেতার কথায়, এই সবই হচ্ছে কাঁচা টাকা। নির্মাণ ব্যবসার নিয়ম মেনে সামান্য কিছু ক্ষেত্রে কাগজপত্রের আদান-প্রদান হলেও সিংহভাগ ব্যবসাই হয় কাঁচা টাকায়। নিচুতলা থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে সেই টাকার বখরা পৌঁছে যায় একেবারে উপরতলায়।
বিরোধীরা তাই বলছেন, সিন্ডিকেটকে কেন্দ্র করে এ রাজ্যে প্রায় সমান্তরাল অর্থনীতি চলছে। বিধাননগরের মেয়র এবং রাজারহাট-নিউটাউনের তৃণমূল প্রার্থী সব্যসাচী দত্ত তো টাইমস নাও-এর ক্যামেরায় স্বীকারই করে নিয়েছেন যে, সিন্ডিকেট না-থাকলে সরকারই উল্টে যাবে!
এই সিন্ডিকেট ব্যবস্থার সূত্রপাত অবশ্য বাম আমলেই। বাম নেতারা সে কথা অস্বীকারও করেন না। কিন্তু মমতার আমলে তার বাড়বাড়ন্ত এবং জুলুমবাজি অন্য মাত্রা নিয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ। রাজারহাট-নিউটাউনে এ বারের বাম প্রার্থী নরেন্দ্রনাথ (বলাই) চট্টোপাধ্যায়ই যেমন দাবি করছেন, ‘‘জমিহারাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সমবায় তৈরি করে ইমারতি কাঁচামাল সরবরাহের ব্যবসার সুযোগ দেওয়া হয় বাম আমলে। কিন্তু তৃণমূল সেটাকে সিন্ডিকেট বানিয়ে একটা সমান্তরাল অর্থনীতি চালাচ্ছে।’’ পাশাপাশি সব্যসাচীবাবু বুধবারও জোর গলায় বলেছেন, ‘‘আপনারা যাদের সিন্ডিকেট বলেন, আসলে তা সমবায় সমিতি। এদের ট্রেড লাইসেন্স আছে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে, সমবায়ের রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। এই সবই সরকারি অনুমোদন। সরকার যদি অনুমোদন দেয়, তা হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে বাধা কোথায়?’’
রাজ্য প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে, বাম আমলে গোটা ব্যাপারটা ছিল শুধু রাজারহাট-নিউটাউনে, নিয়ন্ত্রিত আকারে। এখন তার পরিসর বেড়েছে, দাবিদারও বেড়েছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘আগে ছিল ‘এক জানলা’ নীতি। রক্তদান শিবির থেকে ফুটবল ম্যাচ, বাড়ি তৈরি থেকে জমির দালালি, বালি ও কয়লার খাদান থেকে গরু পাচার— এখন শত ফুল বিকশিত।’’
নিউটাউনের সিন্ডিকেটের শিকড় যেমন ছড়িয়ে রয়েছে বীরভূম-পুরুলিয়া-বর্ধমানেও। নিউটাউন এলাকার সিন্ডিকেট চক্র ছাড়া ওই সব জেলার খাদান থেকে বালি-পাথর কিনতে পারবেন না নির্মাণ ব্যবসায়ীরা। প্রোমোটারেরা বালি-পাথর কিনতে গেলেই এলাকার সিন্ডিকেটের কাছে খবর পৌঁছে যায়। খাদানের বাইরে ছোট ছোট গুমটি ঘরে সিন্ডিকেটের অফিস। মালপত্র কতটা লাগবে— হিসেব করে তাদের হাতে কড়কড়ে নোট গুনে দিলে তবেই গাড়ি লাগানো যাবে খাদানে। এক সিন্ডিকেট চাঁই জানান, কোনও প্রোমোটার যদি সিন্ডিকেটকে রাজি করিয়ে ইমারত সামগ্রী না-ও কেনেন, তা হলেও তাঁকে সিন্ডিকেটের ‘পাওনা’ মেটাতে হবে। ওই ব্যক্তি জানান, ইমারতি সামগ্রী সরবরাহের পাশাপাশি নির্মাণের কাজেও ঢুকে পড়েছে সিন্ডিকেট। এমনকী কোনও সংস্থা ব্যবসা করলে কাজের লোক, মায় জেনারেটরও নিতে হবে তাঁদের থেকে— এটাই নিয়ম।
চোখ রাখুন বর্ধমান-বীরভূম-বাঁকুড়া-রানিগঞ্জে। খোলামুখ খনি থেকে বেআইনি ভাবে কয়লা তুলে তা বস্তায় ভরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই কারবারে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা উড়ছে। মূলত, স্পঞ্জ আয়রন কারখানা, ইটভাটা, গ্রামাঞ্চলে জ্বালানি এবং ফায়ারব্রিক তৈরির কারখানায় সিংহভাগ কয়লা আসে পাচার হয়ে। এই কারবার নিয়ন্ত্রিত হয় দুর্গাপুর থেকে, এক মৈথিলি ব্রাহ্মণের মাধ্যমে। পুরুলিয়ায় কারবার চালান জনৈক লালা। রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশকে মোটা টাকা দিয়েই এই বেআইনি কারবার চলছে। আগে এই কারবারে ‘নজর’ রাখতেন শাসক দলের এক সাংসদ। গত দু’বছর ধরে ‘তহবিল সামলাচ্ছেন’ কালীঘাটের ঘনিষ্ঠ এক সাংসদ-নেতা।
কয়লার মতোই বালি তোলা হচ্ছে অজয়, ময়ূরাক্ষী, দামোদর ও কংসাবতী থেকে। নদীতে পাঁচ একর জায়গা জুড়ে বছরে ২০ হাজার কিউবিক ফুট বালি তোলার ইজারা সরকারের কাছ থেকে নেয় মালিক। কিন্তু তোলা হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি বালি। এবং সেই বালি ‘ওভারলোড’ করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে, এমনকী বাইরেও। সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে হাজার হাজার টন বালি তুলে নেওয়া়র এই কারবার চলছে শাসক দলের মদতে। বীরভূমের মণ্ডল-হাজরা, বা বর্ধমানের সেনগুপ্ত-দাসদের মাধ্যমে বালির টাকা পৌঁছে যাচ্ছে আদিগঙ্গার পাড়ে।
বিরোধীদের কটাক্ষ, শুধু নিউটাউন নয়। শুধু উড়ালপুল নয়। গোটা রাজ্যই সিন্ডিকেটের জালে জড়িয়ে গিয়েছে। তাঁদের কথায়, সংবাদমাধ্যম হুল ফুটিয়েছে! জাল কাটার
মালিক ভোটাররাই!
আরও পড়ুন...
ভোট বৃদ্ধির ঘোষণায় পুরভোটের অভিজ্ঞতার ছোঁয়া নেই তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy