চিঠিটা হাতে পেয়েই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। একে ভোটের ডিউটি। তার উপর কেতুগ্রাম!
২০১০-এ স্কুলে চাকরি পাওয়ার পরে এ নিয়ে তিন বার ভোটের দায়িত্ব পেলাম। প্রথমে জায়গার নাম জানতে পারিনি। কাটোয়ার কাশীরাম দাস ইনস্টিটিউশনে ট্রেনিংয়ে জানলাম সেকেন্ড পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পড়েছে। দ্বিতীয় চিঠিতে জানলাম, যেতে হবে কেতুগ্রাম।
এমনিতেই ভোট এলেই কেমন যেন অস্থিরতা, আতঙ্ক তৈরি হয়। কোথায় পড়ব, ছাপ্পা-রিগিং-বোমাবাজির মুখোমুখি হতে হবে কি না— এমন নানা চিন্তা আসে। এ বার কেতুগ্রাম শুনে তো ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। যাই হোক, নিজেই নিজেকে সাহস জুগিয়ে ২০ তারিখ সকাল ৬টায় বেড়িয়ে পড়লাম। কাটোয়া ডিসিআরসিতে পৌঁছলাম সকাল ৯টায়। তখনও কেউ আসেননি। পরে সবাই এলে বুথের জিনিসপত্র বুঝে নিলাম। আমাদের বুথ ৭৭ নম্বর গোপালপুর ললিতাসুন্দরী গার্লস উচ্চ বিদ্যালয়। সারা দিন রোদে গরমে কাটিয়ে বিকেল ৩টেয় বাস ছাড়ল। পথের এক ঘণ্টা উৎকণ্ঠায় জানালার বাইরে তাকিয়েই কাটল।
৩টে ৫০-এ বুথে পৌঁছলাম। এই স্কুলে দুটো বুথ। আমাদের সাথেই আরও এক দল পোলিং অফিসার নামলেন। গোটা স্কুলটাই কেন্দ্রীয় বাহিনীতে ভরা। শুনলাম স্কুলে বাহিনীর সেক্টর ক্যাম্প বসেছে। একপাশে চলছে তাদের রান্না। নির্ধারিত রুমে গিয়ে দেখি চার-পাঁচ জন জওয়ান শুয়ে আছেন। একটাই ফ্যান ঘুরছে তাঁদের মাথার উপর, আর একটি বাল্ব জ্বলছে। ঘর ছাড়তে বলতেই মধ্যবয়স্ক এক জওয়ান জানিয়ে দিলেন, তাঁরা ঘর ছাড়বেন না। তাঁর বক্তব্য, রাতে তাঁরা ইভিএম ছেড়ে থাকবেন না। আধা হিন্দি আধা বাংলায় বোঝানোর চেষ্টা করলাম, রাতে অনেক কাগজপত্র সেরে রাখতে হবে। প্রিসাইডিং অফিসার সেক্টর অফিসারকে ডাকলেন। কিন্তু সেক্টর অফিসারের সামনেও ওই জওয়ান অনড়। বুঝলাম এদের সঙ্গেই রাত কাটবে। আসলে অন্য কিছু নয়, ওদের গল্পে কাজের অসুবিধা হতে পারে ভেবেই আপত্তি তুলেছিলাম আমরা।
যাই হোক, হাত-পা ধুয়ে কাজে লেগে পড়লাম। ভোটার স্লিপে সই করতে শুরু করলাম, যাতে ভোটেদেরি না হয়। এ দিকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ওই জওয়ান এসে বললেন, রাতে আমরা যেন ওদের কাছেই খেয়ে নিই। বারবার সবার অভিভাবকের মতো খাওয়া-দাওয়া, সুবিধা-অসুবিধার কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন তিনি। অন্যরাও বললেন, আমরা যেন নিশ্চিন্তে থাকি। কোনও ভয় নেই। ওদের কথায় মনে শক্তি পেলাম। সাড়ে আটটা নাগাদ খেতে বসলাম। ভাত, রুটি সবই ছিল। তবে আমি ভাতের ভক্ত। স্কুল প্রাঙ্গনে মনোরম দখিনা হাওয়ায় ভাত, উচ্ছের তরকারি, ঘন সুন্দর ডাল ও রসগোল্লা দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। জওয়ানদের ভালোবেসে খাওয়ানো সত্যি ভুলতে পারব না। নারকেলের মতো ওদেরও উপরটা শক্ত, ভিতরটা এক্কেবারে নরম শাঁস।
রাতে ঠিক করলাম উঠোনে বেঞ্চ পেতে ঘুমবো। কেন্দ্রীয় বাহিনীর সেই জওয়ান নিশ্চিন্তে ঘুমোতে বললেন। সারা রাত টহল চলল। ওঁদের দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে চোখ বুজলাম। তবে বন্দুক ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর ঘেরাটোপে তো আগে কখনও থাকিনি, তাই বোধহয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বন্দুক-গুলি নিয়ে আজগুবি স্বপ্ন দেখলাম।
ভোর সাড়ে তিনটেয় উঠে তৈরি হয়ে নিলাম। সাড়ে পাঁচটায় চিঁড়ে খেয়ে নিলাম। কী জানি আবার কখন খেতে পাব! ৬টা ১৫ নাগাদ রাজনৈতিক দলের এজেন্টরা চলে এলেন। মক পোল হয়ে যাওয়ার পর ইভিএম সিল করে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ৬টা ৫৫-তে ওই সিনিয়র জওয়ান এজেন্টদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘‘যেটা ঠিক সেটা ঠিক, যেটা ভূল সেটা ভূল। যেন অশান্তি না হয়!’’ ভোট শুরু হল। বেলা সাড়ে বারোটার মধ্যে প্রায় ৬০০ ভোট পড়ল। প্রচন্ড গরমে না খেয়ে আর কাজ করতে পারছিলাম না। দেড়টা নাগাদ বুথ একটু ফাঁকা হতে জওয়ানদের ডাকেই খেয়ে এলাম। তাঁরাই একটু পরে লেবুজল দিয়ে গেলেন। সন্ধ্য ৬টা পর্যন্ত ৮৭% ভোট পড়ল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কেতুগ্রামে যে এত শান্তিতে ভোট করতে পারব ভাবতে পারিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy