দলীয় কার্যালয়ে তোয়াব আলি। আনাজ কাটছেন আমিরুল। নিজস্ব চিত্র।
কাজ নেই, আবার লম্বা অবসরও নেই। দু’সপ্তাহ কেটে গিয়েছে, কিন্তু ১৯ মে, সে তো এখনও ঢের পথ!
আমিরুল বলছেন, ‘‘পনেরোটা দিন বাব্বাঃ!’’
ছিলেন ব্লক কংগ্রেস সভাপতি। নিজেও জানেন না ঠিক কখন দলটা ছেড়েছেন। কিন্তু বিকেল হতেই সমশেরগঞ্জের তৃণমূল প্রার্থি হয়ে গিয়েছিলেন। আমিরুল ইসলামকে কম প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়নি। ভোটে প্রচার করেছেন, তা-ও যেন কেমন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে, অস্বস্তি নিয়ে। আর এখন, তাঁর বাড়ি তো একেবারে কংগ্রেস-তৃণমূল একাকার হয়ে গিয়েছে।
আড় ভেঙে আমিরুল বলছেন, “বেশ ভয় পেয়েছিলাম। দল ছাড়ার কাজটা ঠিক হল কিনা বুঝতে না বুঝতেই ভোট হয়ে গেল।”
ভোট পেরিয়ে ঝাড়া হাত পা হয়ে আমিরুল এখন বলছেন, “সব ভয় কেটে গেছে জানেন, এখন সমশেরগঞ্জে বেশ একটা পরিচিতি পেয়ে গিয়েছি, আর যাই হোক ভোট তো আমাকে চিনিয়ে দিল!’’
আমিরুল বরাবরই মানুষের সঙ্গে মিশে থাকার ছেলে। তৃণমূলের প্রার্থী হলেও তাই তার বাড়িতে এখনও অবাধ আনা গোনা কংগ্রেস কর্মীদের।
ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠাটা আজও অভ্যেস। ক’দিন আগেও দিনটা যেন বড্ড ছোট হয়ে গিয়েছিল তার কাছে । এখন দিন যেন ফুরুতেই চায় না। বাড়িতেই একটা ছোটখাটো বিড়ির কারখানা চালান। এখন সাতসকালেই সেখানে বসছেন। বিড়ি সেঁকা থেকে লেবেলিং দেখাশুনো করছেন নিজের হাতেই।
পেশায় প্রাথমিকের পার্শ্ব শিক্ষক। স্ত্রী অঙ্গনওয়ারি কর্মী। বড় মেয়ে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী, পাশের হাইস্কুলে পড়ে। ছেলে তৃতীয় শ্রেণি। গরমে স্কুলে ক্লাস বন্ধ। নিজে ঘুম থেকে উঠেই সময় কাটাতে একে একে ঘুম থেকে তুলে ছেলে মেয়েদের সঙ্গে ঘন্টা খানেক আড্ডা দিচ্ছেন নিয়ম করে। বলছেন, ‘‘ওদের দিকে কত দিন ফিরেই তাকানো হয়নি।’’ আসলে ১৯ মে পর্যন্ত টেনশনটা ভুলে থাকা আর কি। ভোটের ক’দিন স্নান সেরে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যাওয়া অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিল। এখন কাজে কুঁড়েমি এসে গিয়েছে।
বরাবরই কম কথা বলেন। এবারই প্রথম খবরের কাগজে তাকে নিয়ে এত চর্চা হয়েছে, বিস্তর সমালোচনাও হয়েছে। তাতে ভয় পেয়েছেন বিস্তর। স্ত্রী আনোয়ারা বেগম মনের জোর জুগিয়ে বলেছেন, ‘‘লড় তো তার পরে দেখা যাবে!’’ বলছেন,“ বিশ্বাস করুন মন্টুদার( নির্দল প্রার্থি) উপর কোনও হামলা করিনি আমরা। আমি হামলা করার মত ছেলেই নই। তবু তার উপর হামলায় আমাকেই প্রধান আসামী করা হয়েছে। এটা কেমন কথা!’’
দেখতে দেখতেই সাড়ে ৯টা। প্লেট ভরা ফ্রিজের ঠান্ডা তরমুজ, দু’পিস মিস্টি আর গরম চা। তরমুজ মুখে তুলে বলছেন, “জানেন তরমুজ শরীরকে ঠান্ডা রাখে। আমার বাড়ির সকলেই খুব ভালবাসে। তাই টিফিনে তরমুজ, এমনকী বাড়িতে অতিথি এলেও সাজিয়ে দিই প্লেটে।’’ আপনি নিজেও কি তেমনই, বাইরে একরকম রং আর ভিতরে অন্যরকম? আমিনুল হাসছেন।
ঝাড়খন্ড তার বাড়ির দুয়োর থেকে বড়জোর আধ কিলোমিটার। সীমান্তের প্রান্ত এলাকা বলে আমিরুলের বাড়ির সামনের রাস্তাকে রাস্তা না বলে ডহর বলাই ভাল। বাড়ির পাশেই পুটিমারি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র বন্ধ প্রায় ৪০ বছর থেকে। বলছেন, “জানেন এত দিন ধরে এমপি, এমএলএরা আসছেন কিন্তু কোনও উন্নয়ন নেই এই দোগাছিও ভাসাই পাইকর এলাকায় । বড় আশা করে আমার এলাকার মানুষ ঝেড়ে এ বার ভোট দিয়েছেন। এখন থেকেই বাড়িতে ধর্না সামলাতে হচ্ছে রোজ, যেন জিতেই গেছি ভোটে। জিতব কিনা জানি না। তবে লড়াই হবে ভালই।’’ আর জিতলে? ‘‘সেটা হবে মিরাকল, কারণ আমি তো জেলার কোনও দলের এমনকী নিজের দলের নেতাদের কাছেও ধর্তব্যের মধ্যেই নেই।’’
সিপিএম প্রার্থি তোয়াব অবশ্য আর্লি রাইজার। ভোর সাড়ে চারটে। মুখ ধুয়ে দাড়ি কামিয়ে মৌজ করে এক কাপ চা। তার পর ঘড়ি ধরে টানা ৪৫ মিনিট ফ্রি-হ্যান্ড। ভোটের সময়তেও এটা বন্ধ করেন কখনও। ঘাম ঝরিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে কাগজ পড়া। বলছেন, “বয়স ৬০ পেরিয়েছে, শরীরটা তই ঠিক রাখতে হবে তো।“
তারপর স্নান সেরে পান্তা ভাত, সঙ্গে লবন, তেল, লঙ্কা, ছাতু। পোড়ানো শুকনো লঙ্কা হলে তো কথাই নেই। তবে শুকনো লঙ্কায় প্রধান বাধা গিন্নির।
সব কিছু সেরে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ৯টা। তারপর বেরিয়ে পড়া। গন্তব্য একটাই— দলীয় কার্যালয়।
বলছেন,“ দলের সর্বক্ষণের কর্মী আমি। জোনাল সম্পাদকও। তাই বেলা ৯টা থেকেই দলের অফিস আমার ঠিকানা। ভোটের মাস খানেক সে ঠিকানা বললালেও এখন দলের কর্মসূচী না থাকলে পার্টি অফিসই আমার ঠাঁই। সামনে ১২ হাত দূরে ১২ ইঞ্চির ছোট টেলিভিসন সারাক্ষণ খোলা সংবাদ চ্যানাল। দলীয় অফিসেই খাওয়া দাওয়া দুপুরের। বাড়ি ফিরতে রাত দশটা। ভোটের ক’দিন অবশ্য অনেকটাই বদলে গেছিল এই রুটিন। বর্তমানে এই কেন্দ্রেরই বিধায়ক তোয়াব আলি।
এ বার হেরে গেলে? বেলা সাড়ে ১২টাতেও বুথওয়াড়ি দলের সম্ভাব্য ভোটের প্রাপ্তির তালিকা তৈরি করতে ব্যস্ত। মানেন জোটের প্রার্থি হলেও সামশেরগঞ্জ নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা রয়েছে দলের।
বলছেন,“এত দীর্ঘদিনের মেয়াদ ধরে নির্বাচন হওয়া উচিত নয়। টানা দু’মাস ধরে অফিসগুলিতে কোনো কাজ হচ্ছে না। পঞ্চায়েত, পুরসভার উন্নয়ন বন্ধ। আর মুখে যতই বলি টেনশন নেই , কিন্তু সেটা কি আর কাটানো যায়? গণনা না হওয়া পর্যন্ত সেটা তো থাকবেই। তাই কাজ নিয়েই মেতে আছি। ওতেই ভুলে থাকা যায়। ভাল থাকাও!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy