Advertisement
০৪ মে ২০২৪

নতুন লড়াইয়েও লক্ষ্মণকে বিঁধছে নন্দীগ্রাম শেল

দল তাঁকে ছেড়েছে। তিনিও সকাল-সন্ধে পুরনো দলের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন। তবু অতীত পিছু ছাড়ছে কই! যে নন্দীগ্রাম কাঁটায় রক্তাক্ত হয়ে তাঁর জীবনটাই পাল্টে গিয়েছে,মুছে গিয়েছে সিপিএমের সঙ্গে সব সম্পর্ক, ন’বছর পরেও সেই নন্দীগ্রামের ছায়া ছেড়ে বেরোতে পারছেন না লক্ষ্মণ শেঠ।

এখন ভরসা ভগবানেই। নিজের দলীয় কার্যালয়ে লক্ষ্মণ শেঠ। ছবি: আরিফ ইকবাল খান

এখন ভরসা ভগবানেই। নিজের দলীয় কার্যালয়ে লক্ষ্মণ শেঠ। ছবি: আরিফ ইকবাল খান

সামসুদ্দিন বিশ্বাস
হলদিয়া শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৬ ০৪:৫৬
Share: Save:

দল তাঁকে ছেড়েছে।

তিনিও সকাল-সন্ধে পুরনো দলের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন।

তবু অতীত পিছু ছাড়ছে কই!

যে নন্দীগ্রাম কাঁটায় রক্তাক্ত হয়ে তাঁর জীবনটাই পাল্টে গিয়েছে,মুছে গিয়েছে সিপিএমের সঙ্গে সব সম্পর্ক, ন’বছর পরেও সেই নন্দীগ্রামের ছায়া ছেড়ে বেরোতে পারছেন না লক্ষ্মণ শেঠ।

আজ, বৃহস্পতিবার হলদিয়ার জেলায় ভোট। লক্ষ্মণও তাঁর পুরনো তালুক হলদিয়াতেই আছেন। এমনকী পার্টি অফিসের ঠিকানাটাও বদলায়নি। ক্ষুদিরামনগরে যে বাড়িতে সিপিএমের হলদিয়া জোনাল কার্যালয় ছিল, এখন সেখানেই লক্ষ্মণের নতুন দল ‘ভারত নির্মাণ পার্টি’র অফিস।
পুরনো চেয়ারে বসে ভোটের ২৪ ঘণ্টা আগে কথা বলতে গিয়ে ঘুরে ফিরে সেই নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গে ফিরলেন সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ। গলা চড়িয়ে বললেন, “নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের পরে বুদ্ধবাবু (বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য) এমন ভাবে বলে দিলেন, যেন সব দায় আমার। নন্দীগ্রামবাসীর কাছে আমাকে খারাপ করে দিল সিপিএম। আমার উপর তৃণমূলের লোকজনের ক্ষোভ তৈরি হল।’’

সেই ক্ষোভে যে জল পড়েনি তা জানেন পোড়খাওয়া নেতা। তাই এ বার ভোটে কিরণময় নন্দের দলের হাত ধরে নন্দীগ্রাম-সহ পূর্ব মেদিনীপুরের ১৩টি আসনে ‘ভারত নির্মাণ পার্টি’ প্রার্থী দিলেও প্রচারে নন্দীগ্রাম-খেজুরির ধারপাশ মাড়াননি লক্ষ্মণ। কেন? জবাবেও সেই নন্দীগ্রাম-ভীতি— ‘‘আমি গেলে সেখানে উত্তেজনা তৈরি হতে পারে, দলীয় কর্মীরা আক্রান্ত হতে পারেন। তাই আমি নন্দীগ্রামে যাইনি।”

যেখানে প্রচারে গিয়েছেন সেখানেও বারবার আওড়েছেন নন্দীগ্রামের কথা। আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের দায় তাঁর নয়, বাম সরকারের। কিন্তু জেলার নানা প্রান্তে সভা-মিছিল মিলিয়ে যে ৬০টি কর্মসূচি লক্ষ্মণ করেছেন, তার কোনওটিতেই দু’শোর বেশি জমায়েত হয়নি। তবু কেন দল গড়ে ভোটে লড়া?

লক্ষ্মণ নিজে বলছেন, ‘‘রাজনীতিটাই তো শুধু পারি।’’ যদিও হলদিয়ার হাওয়ায় অন্য খবর। সেখানে ভাসছে, লক্ষ্ণণের সংস্থা ‘আই-কেয়ার’-এর অধীনে মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-সহ ১৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেই সূত্রে সাম্রাজ্যের পরিধি নেহাত ছোট নয়। আর তা রক্ষা করতেই রাজনীতিতে থাকাটা জরুরি। সিপিএমের জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহিরও বক্তব্য, “লক্ষ্মণ শেঠ নিজের ব্যবসা বাঁচাতেই রাজনীতি আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন।’’

যে কারণেই হোক, সত্যিটা হল লক্ষ্ণণ আর রাজনীতি এখনও জড়িয়ে, যেমন জড়িয়ে নন্দীগ্রামের সঙ্গে তাঁর নাম। তমলুকের তিন বারের প্রাক্তন সাংসদের নির্বাচনী এলাকার মধ্যেই পড়ত এই নন্দীগ্রাম। এমনকী হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ (এইচডিএ)-এর চেয়ারম্যান হিসেবে লক্ষ্মণ যখন বন্দর-শহরের ‘বেতাজ বাদশা’, বুদ্ধবাবুর আমলে মহাকরণের অলিন্দে যখন শোনা যেত ‘হলদিয়ার মুখ্যমন্ত্রী তো আসলে লক্ষ্মণ শেঠ’— সেই সময়ও এইচডিএ-র অধীনে ছিল নন্দীগ্রাম। দাপটে ‘শাসন’ করা সেই এলাকাই পরে লক্ষ্মণের ‘বধ্যভূমি’ হয়ে ওঠে।

২০০৭-এর ১৪ মার্চ গুলিচালনার পরে ক্রমে নন্দীগ্রামের ‘খলনায়ক’ হয়ে ওঠেন লক্ষ্মণ। ২০০৮-এর পঞ্চায়েত ভোট থেকে জেলায় সিপিএমের রাশ আলগা হতে শুরু করে। সেই ভোটেই সিআরপি অফিসার অলোক রাজের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার সময় বাদানুবাদে জড়িয়েছিলেন লক্ষ্মণ। তেখালি সেতুতে দাঁড়িয়ে সে দিন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে মোবাইলের স্পিকার চালু করে দিয়েছিলেন সিআরপি কর্তা। গোটা বাংলা শুনেছিল তমলুকের তৎকালীন সাংসদের দাপট।

তারপর থেকে প্রতি ভোটেই নন্দীগ্রাম তাড়া করে বেরিয়েছে লক্ষ্মণকে। ২০০৯-এর যে লোকসভা নির্বাচনে হেরে তাঁর সাংসদ তকমা ঘুচেছে, সেই ভোটেও নিয়ন্ত্রক ছিল নন্দীগ্রাম। জমি আন্দোলনের সেনাপতি হিসেবেই সে বার অনায়াস জয় পেয়েছিলেন ঘাসফুলের প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী। আর ২০১১-তে তো নন্দীগ্রামের জেলা থেকে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে সিপিএম। তার পরের বছর লক্ষ্মণ-জায়া তমালিকা পণ্ডা শেঠের নেতৃত্বে লাল-শিবির হলদিয়া পুরসভা দখল করলেও সেই জয় থিতু হয়নি। কিছু দিনের মধ্যেই পুরবোর্ড হাতিয়ে নিয়েছে তৃণমূল।

ইতিমধ্যে হলদি নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। নন্দীগ্রাম-পর্বের মামলায় জেল খেটেছেন লক্ষ্মণ। দলবিরোধী কাজের অভিযোগে ২০১৪-র লোকসভা ভোটের মুখে তাঁকে বহিষ্কার করেছে সিপিএম। মচকালেও লক্ষ্মণ কিন্তু ভাঙেননি। এক ঝাঁক পুরনো সিপিএম নেতাকে সঙ্গী করে নতুন দল গড়েছেন। সেই দলের ভরসাতেই নিজের জীবন নতুন করে নির্মাণ করতে চাইছেন।

আর সেই নতুন অঙ্কে যাদের সঙ্গে এক দিন লক্ষ্মণের লড়াই ছিল, পরোক্ষে সেই তৃণমূলের ‘বন্ধু’ হয়ে উঠছেন তিনি। ক’দিন আগে হলদিয়ায় নির্বাচনী জনসভায় খোদ শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, “কোলাঘাট থেকে দিঘা পর্যন্ত লক্ষ্মণ শেঠ আর কিরণময় নন্দ যে ভাবে সিপিএমের কাজের সমালোচনা করছেন, তাতে আমার অর্ধেক কাজ কমিয়ে দিয়েছেন।” তাঁর আরও সংযোজন, ‘‘এ বার হলদিয়ায় সিপিএম নয়, দ্বিতীয় হবেন লক্ষ্মণ শেঠের প্রার্থী প্রার্থী অভিমন্যু মণ্ডল।’’

সিপিএম নেতৃত্ব অবশ্য এ সবে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। জেলা সম্পাদক নিরঞ্জনবাবুর সাফ কথা, ‘‘লক্ষ্মণ শেঠ নিজের স্বার্থে তৃণমূলের গুণগান আর আমাদের সমালোচনা করছেন। মানুষ সেটা জানে। ফলে, ভোটে এ সবের প্রভাব নেই।’’

যেমন লক্ষ্মণের পরনে আগের মতো লাল পাঞ্জাবি নেই, পার্টি অফিসের বাইরে গাড়ির লম্বা লাইন নেই, ঘিরে থাকা জনা পঞ্চাশেক অনুচরও নেই। তবে কপালে চন্দন আর মুখে নন্দীগ্রাম-নাম, সেই একই রয়ে গিয়েছে।

সব অতীত যে সহজে পিছু ছাড়ে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE